ফেসবুকে ছেলেটার খবরটা পড়েই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল স্টিভ ইন্সের। ২০১২-র শেষ। বছর কুড়ির ছেলেটির হৃদযন্ত্র বিকল হতে বসেছিল। সে দিন তাঁকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল কোনও এক অজানা ব্যক্তি। এ কাহিনি প্রৌঢ়কে এক ধাক্কায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক বছর আগে। নিজের ছেলের দুর্ঘটনায় মৃত্যু আর তাঁর শেষ ইচ্ছে চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল প্রত্যেকটা অধ্যায়।
আর দেরি করেননি স্টিভ। ফেসবুকের সূত্র ধরে খোঁজখবর শুরু করেন। পেয়েও যান উইল পোপের ই-মেল আইডি। যোগাযোগ করেন ছেলেটির সঙ্গে। ক্রমশ স্পষ্ট হয় ছবিটা। স্থান-কাল-পাত্র মিলিয়ে স্টিভের যে সন্দেহটা হয়েছিল, সেটাই সত্যি। উইলের শরীরে বেঁচে রয়েছে তাঁরই ছেলের দেহাংশ।
মাথায় ঝাঁকড়া সোনালি চুল। বছর একুশের তরুণ এখন তরতাজা। শরীরের উপর দিয়ে যে এত ঝড়-ঝাপটা গিয়েছে, তার লেশমাত্র নেই। তাঁর মুখেই শোনা গেল ঠিক এক বছর আগের কথা। এমনই একটা বড়দিনের মরসুম। উৎসবের আলোয় সেজেছে ব্রিটেন। সে আলোর রেশ নেই হাসপাতালের শয্যায়। সেখানে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন উইল। তাঁর হৃদযন্ত্র কাজ করছে না। হৃৎপিণ্ড দান করতে পারে, এমন কাউকে পাগলের মতো খুঁজে চলেছেন উইলের বাবা-মা।
শীতের দুপুরে বাড়ির বাগানে বসে সে দিনগুলোর কথা বারবারই মনে পড়ে উইলের। মাঝের একটা বছরে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। কোনও এক অজানা বন্ধুর হৃদযন্ত্রে এখনও বেঁচে আছেন তিনি। সে ছেলে না মেয়ে, তাঁরই মতো অল্পবয়সী কেউ, নাকি বৃদ্ধ, জানতেন না কিছুই। নিয়ম অনুযায়ী গোপন রাখা হয় দাতার নাম-ধাম-পরিচয়। শুধু বুকের ধুকপুকনি সব সময় জানান দিয়ে যায়, অজ্ঞাতপরিচয় সেই বন্ধুর কথা। উইল বললেন, “আমি শুধু জানতাম, আমার বেঁচে থাকার অর্থ কারও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া। সেটা মেনে নেওয়াই
বড্ড কষ্টের।”
সেই বন্ধুর পরিচয় যে এক দিন জানতে পারবেন, কল্পনাও করতে পারেননি উইল। স্টিভের মুখে জানতে পারলেন তাঁর সেই বন্ধুর কথা। একেবারে তাঁরই বয়সী ছিল টম ইন্স। ব্রিস্টলের বাসিন্দা টম ইলেট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ শিক্ষানবিশের কাজ করতেন। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর এক পথ দুর্ঘটনায় গুরুতর ভাবে জখম হন তিনি। সে দিন মারাত্মক বৃষ্টি হচ্ছিল। পিছল রাস্তায় টমের গাড়ি গিয়ে ধাক্কা মারে একটি গাছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, তাঁর মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়ে গিয়েছে। টমের বাবা-মা জানতেন, ছেলে অঙ্গ-দান করেছিল। ডাক্তাররা জানান এক মাত্র জীবনদায়ী ব্যবস্থাতেই বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব টমকে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা টমকে বাঁচিয়ে রাখতে চান, নাকি ছেলের অঙ্গ দান করবেন? সে দিন ওই অবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল টমের বাবা-মা স্টিভ-সুকে। বললেন, “সে দিন না বলাটা অনেক সহজ হত। বলতে পারতাম, ওকে একদম ছোঁবেন না। কিন্তু তা হলে তো টমের ইচ্ছের অমর্যাদা করা হত।”
উইল জানালেন, হঠাৎই এক দিন একটা ই-মেল পান তিনি। তাতে লেখা, “তোমার শরীরে যাঁর হৃদযন্ত্র রয়েছে, আমি তাঁর বাবা।” প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলেন তরুণ। কী বলবেন, কী ভাবে এমন একটা ই-মেলের জবাব দেবেন, বুঝতে পারছিলেন না কিছুতেই। কিন্তু চিঠির একটা লাইন ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁর মনকে। স্টিভ লিখেছিলেন, “তুমি আমার ছেলের শেষ ইচ্ছে পূরণ করেছো। তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ।”
সেই শুরু। ই-মেল, ফোন। শেষে এক দিন ঠিক করে ফেলেন, দেখা করবেন দু’জনে। উইলকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরেছিলেন স্টিভ। সকলের অলক্ষ্যে হয়তো কান পেতে ছিলেন তাঁর বুকে। যেখানে এখনও বেঁচে তাঁর একমাত্র ছেলের স্পন্দন। |