|
|
|
|
টাকা আদায় করতে হবে? টোকা দিলেই দোরে বাউন্সার |
অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
পানশালা থেকে চ্যাংদোলা করে মাতাল বের করা বা নিশিনিলয়ের দোর আগলানো ‘বাউন্সার’ বলতে এত দিন সেই সব লম্বা-চওড়া মুশকো চেহারার লোকেদেরই বুঝে এসেছে কলকাতা তথা গোটা রাজ্য।
ছবিটা আচমকা পাল্টে গেল পরপর দু’টি ঘটনায়। কলকাতার শর্ট স্ট্রিটে জমি দখল আর তার ঠিক এক মাসের মাথায় বর্ধমানে ব্যাঙ্কের পাওনা আদায়ে দেখা গেল আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ভাড়াটে বাহিনীকে। বোঝা গেল,
১) ফুর্তিফার্তা সামাল দেওয়ার চেয়ে গুরুতর কাজে নামানো হচ্ছে অল্পবয়সী ছেলেদের, এমনকী মেয়েদেরও।
২) কখনও পুলিশকে এড়িয়ে, কখনও সঙ্গে জুটিয়ে কিছু ভুঁইফোঁড় সংস্থা এই কারবারে নেমেছে।
৩) শুধু শর্ট স্ট্রিটে অভিযুক্তদের মতো সম্পত্তিলোভীরা নয়, কোনও-কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কও ‘রিকভারি এজেন্ট’ হিসেবে এদের ব্যবহার করছে।
বাউন্সার জোগানোর সংস্থাগুলির মূল কাজ হল, পয়সা দিলেই আবাসনে-অফিসে বন্দুক হাতে প্রহরী বা কাউকে চমকাতে ‘গানম্যান’ পাঠানো। কলকাতা শহর তো বটেই, লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনা জুড়েও ছড়িয়ে পড়েছে তাদের জাল। উত্তর শহরতলির দুর্গানগর, মধ্যমগ্রাম-বারাসত থেকে শুরু করে হাবরা, এমনকী নদিয়ার রানাঘাটেও ফলাও কারবার শুরু হয়েছে। বেশির ভাগের পোশাকি নামে রয়েছে ‘সার্ভিস’ বা ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট’ কথাগুলি। পুলিশের মতে, এই সংস্থাগুলি এবং তাদের কাজ পুরোপুরি অবৈধ।
বর্ধমানের ভাঙাকুঠিতে ইউবিআই-এর হয়ে যে সংস্থাটি বাউন্সার পাঠিয়েছিল, সেটির নাম ‘স্যাম অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট।’ সেটির কর্তা জিয়ারুল হক-সহ সাত জন আপাতত শ্রীঘরে। বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরের জয়পুল এলাকার ওই সার্ভিস সেন্টারটি অবৈধ।” |
|
বর্ধমানে ধৃত বাউন্সারেরা। —ফাইল চিত্র। |
এ রকম অনেক জিয়ারুলই কিন্তু চুটিয়ে কারবার করছেন। বারাসত স্টেশনের পাশেই একটি ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে চলছে বাউন্সার, গানম্যান সরবরাহের কাজ। চব্বিশ ঘণ্টা ‘সার্ভিস’ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া ওই সংস্থার সাইনবোর্ডে লেখা, ‘এনলিস্টমেন্ট নম্বর - ২০০২৫১৫০৯৯’। এটা কীসের লাইসেন্স, সরকারের কী অনুমতি আছে, তা অবশ্য জানাতে পারলেন না সংস্থার কর্তা তপন রায়। তবে তাঁর গ্যারান্টি “বাউন্সাররা আপনার ছাড়া আর কারও কথা শুনবে না। মাসে ২৬ দিন ৮ ঘণ্টা করে কাজ করবে। মাসে ৯ হাজার টাকা বেতন দিতে হবে। আমরা কেবল ১২% সার্ভিস ট্যাক্স নেব। পুলিশ-প্রশাসনের অসুবিধা হলে আমরাই বুঝে নেব।’’
৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার বিমান দত্ত কখনও বাউন্সার, কখনও নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। বিমান বলেন, “আমাদের নানা কাজ করতে হয়। মালিক যেমন বলেন। ৮ ঘণ্টার জায়গায় ১২ ঘণ্টা ডিউটি দিতে হয়। মাসে ৬ হাজার টাকা পাই, বাকিটা সংস্থা নেয়।” লোকের উপরে জুলুম করতে খারাপ লাগে না? বিমান বলেন, “সংসার চালাতেই কাজে নেমেছি। আমাদের কী দোষ বলুন?’’ আরেকটি বাউন্সার সংস্থার মালিক সুমন দেবনাথ আবার বলেন, “বাউন্সার বা গ্যানম্যান কী করবে, তা তো মালিকের উপরে নির্ভর করবে।” সংস্থার লাইসেন্স দেখতে চাইলে শুধু বাড়িওয়ালার সঙ্গে ১১ মাসের চুক্তির কাগজ ছাড়া আর কিছুই অবশ্য তিনি দেখাতে পারেননি।
রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশ বেশি ধাক্কা খেয়েছেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বাউন্সার নামানোয়। তাঁদের প্রশ্ন: যদি বাউন্সার জোগানো সংস্থাগুলি অবৈধ কাজ করে থাকে, তাদের যারা বরাত দিয়েছে তারাই বা দায়ী হবে না কেন?
ব্যাঙ্কের বক্তব্য, কোনও ব্যক্তি ঋণ ফেরত না দিলে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় বা তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত নতুন কিছু নয়। ‘সারফেসি’ আইনে তা করতেই পারে ব্যাঙ্ক। কিন্তু তার নির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে।
স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার এক কর্তা জানান, ঋণগ্রহীতাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে, সতর্ক করে, সহজ কিস্তির ব্যবস্থা করেও যদি পাওনা আদায় করা না যায় তখনই সম্পত্তি দখল নেওয়ার পরিস্থিতি আসে। বারাসত আদালতের সরকারি কৌঁসুলি শান্তময় বসু জানান, “আদালতের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।” ব্যাঙ্ক প্রথমে সংশ্লিষ্ট জেলাশাসককে জানাবে। তিনি জানাবেন পুলিশকে। উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক সঞ্জয় বনশল বলেন, ‘‘পুলিশ যখন সময় দেবে, তখন তাদের উপস্থিতিতেই ব্যাঙ্ক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে।” বর্ধমানে পুলিশ সময় না দেওয়াতেই তারা ‘রিকভারি এজেন্ট’ পাঠিয়েছিল বলে ইউবিআই কর্তৃপক্ষের দাবি।
ব্যাঙ্কের কর্তারা অবশ্য বলছেন, দরকারে ‘রিকভারি এজেন্ট’ নিয়োগও বেআইনি নয়। ইউবিআই-এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভাস্কর সেনের ব্যাখ্যা, “এ ব্যাপারে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা রয়েছে। সাধারণত ব্যাঙ্কিং শিল্পে চালু নিয়ম হল, নির্দেশিকা মেনে ব্যাঙ্কের পরিচালন পর্ষদ রিকভারি এজেন্ট নিয়োগ করে। এজেন্টের কী-কী কাজ, তারা কী করতে পারবে বা পারবে না, তা ব্যাঙ্কই ঠিক করে দেয়। এজেন্টকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।”
তারা কি লোকের মাথায় বন্দুক ঠেকাতে পারে? বর্ধমানে ঋণগ্রহীতার স্ত্রীর মাথায় লাইসেন্স-বিহীন দেশি ওয়ান শটার বন্দুক ঠেকিয়ে গায়ের গয়না খুলে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ব্যাঙ্কের কর্তারা একবাক্যে মেনে নিচ্ছেন, কোনও অবস্থাতেই ‘রিকভারি এজেন্ট’ বেআইনি অস্ত্র সঙ্গে রাখতে অথবা অন্য কোনও বেআইনি কাজ করতে পারে না। কেননা ব্যাঙ্কের এজেন্ট হিসেবে কাজের সময়ে তাদের আচরণের দায়দায়িত্ব ব্যাঙ্কের উপরেই বর্তায়। বর্ধমানে অভিযুক্ত এজেন্টের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, ইউবিআই অবশ্য তা এখনও খোলসা করে বলেনি।
বর্ধমানে নয় কয়েক জনকে ধরা হয়েছে, ঢালাও বাউন্সার-কারবার রুখতে পুলিশই বা কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? পুলিশকর্তাদের কথায় পরিষ্কার, অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমার সময়ে যেমন পুলিশ নিজে থেকে কিছু করতে যায়নি, এ ক্ষেত্রেও তা-ই। সাধারণ মানুষ রোজ যা দেখছেন, খাতায়-কলমে তা পুলিশের ‘অজানা’। ফলে, ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্নও আসে না। যেমন উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরীর ব্যাখ্যা, “এই রকম সংস্থা খোলার জন্য পুলিশের কোনও অনুমতি লাগে না। তবে নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা খতিয়ে দেখি। বর্ধমানের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে।” এমন সংস্থা কোথায় কত খোলা হয়েছে, তার কোনও তথ্যও পুলিশের কাছে নেই। |
(সহ-প্রতিবেদন: প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী) |
পুরনো খবর: বাউন্সারদের জেল হাজত |
|
|
|
|
|