নয়াচরের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রের দুই মন্ত্রক দু’রকম অবস্থান নেওয়ায় প্রকল্পটি কবে ছাড়পত্র পাবে, তা নিয়ে সংশয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলই।
অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্র বড় মাপের পরিকাঠামো প্রকল্পগুলিকে দ্রুত ছাড়পত্র দিতে চাইছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বিনিয়োগ সংক্রান্ত কমিটি যে ছ’টি প্রকল্পকে বাছাই করেছে, তার মধ্যে রয়েছে নয়াচরের ‘সাগর সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রোজেক্ট’। এ জন্য পরিবেশ মন্ত্রককে দু’সপ্তাহের মধ্যে ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি নয়াচরের প্রকল্পের জন্য আরও আটটি সমীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়েছে। যা শেষ করতে অন্তত তিন থেকে চার মাস সময় লাগবে।
নয়াচরে ১৪ হাজার কোটি টাকার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ইউনিভার্সাল সাকসেস গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি করেছে পশ্চিমবঙ্গ। প্রকল্পের ছাড়পত্র আদায়ের জন্য কিছু দিন আগেই শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় রাজ্যের আমলাদের পরিবেশ মন্ত্রকে পাঠান। ইউনিভার্সাল সাকসেস গোষ্ঠীর কর্ণধার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ও একই কারণে দিল্লিতে দরবার করছেন। সম্প্রতি প্রসূন পরিবেশমন্ত্রী জয়ন্তী নটরাজনের সঙ্গে বৈঠকও করেন। জয়ন্তী প্রসূনবাবুকে আশ্বাস দেন, বিষয়টি দেখবেন।
তবে ছাড়পত্রের বিষয়টি আটকে রয়েছে পরিবেশ মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে। গত ১৮ ও ১৯ নভেম্বর বিশেষজ্ঞ কমিটির বৈঠক হয়েছে। তার ভিত্তিতে কমিটির নির্দেশ, ১৩২০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য আরও ৮ রকম সমীক্ষা করিয়ে তার রিপোর্ট জমা দিতে হবে। এ জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছে।
কী কী সমীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে?
এক, প্রকল্পটি উপকূলবর্তী নিয়ন্ত্রণ এলাকার মধ্যে পড়ে কি না।
দুই, হুগলির মোহনায় পরিবেশগত ভারসাম্যের উপর প্রকল্পটির প্রভাব।
তিন, পুণের কেন্দ্রীয় জল ও বিদ্যুৎ গবেষণা কেন্দ্র অথবা আইআইটি-রুরকিকে দিয়ে নয়াচর দ্বীপের স্থায়িত্ব ও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা খতিয়ে দেখা।
চার, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওশানোগ্রাফি অথবা আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে চার পাশের পরিবেশগত সমীক্ষা।
পাঁচ, জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলার দিকটি খতিয়ে দেখা।
ছয়, হলদিয়ার দূষিত এলাকার উপর এই প্রকল্পের প্রভাব খতিয়ে দেখা।
সাত, ফ্লাই অ্যাশ বা তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের ছাই কী ভাবে কাজে লাগানো হবে, সেই সংক্রান্ত স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
আট, এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আদালতে জমে থাকা মামলার বিশদ বিবরণ।
রাজ্যের শিল্প দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, এত সব সমীক্ষা করে রিপোর্ট পেয়ে তা জমা দিতেই তিন থেকে চার মাস লাগবে। তত দিনে লোকসভা ভোট চলে আসবে। ফলে গোটা প্রক্রিয়াটাই বিশ বাঁও জলে চলে যেতে পারে। ইউনিভার্সাল সাকসেস গোষ্ঠীর বিদ্যুৎ সংস্থা ইউনিভার্সাল ক্রেসেন্টের সিইও পি কে মোদী বলেন, “শুধু যে যথেষ্ট সময় লাগবে, তা নয়। আমাদের হিসেব অনুযায়ী, অন্তত ৮ কোটি টাকা খরচ হবে।”
কী বলছে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক? বিদ্যুৎ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে অন্তত ৭০টি বিদ্যুৎ প্রকল্প সরকারি ছাড়পত্রের অপেক্ষায় রয়েছে। এই ৭০টি প্রকল্পের লগ্নির মূল্য চার লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। নয়াচর-সহ ছ’টি প্রকল্পকে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য বাছাই করা হয়েছে। এগুলিকে ছাড়পত্র দেওয়ায় কোথায় সমস্যা, তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকগুলির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু নয়াচরের ক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রক ছাড়পত্র না দিলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বিনিয়োগ সংক্রান্ত কমিটির পক্ষে কিছু করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিদ্যুৎ মন্ত্রকের কর্তারাও।
পরিবেশ বনাম শিল্পের এই বিরোধে নতুন লগ্নি আটকে থাকা নিয়ে প্রথম থেকেই ভুগছে ইউপিএ-সরকার। গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রক আয়োজিত দিল্লি ইকনমিক কনক্লেভেও এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজনের যুক্তি, “নতুন শিল্প হলে পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি হবেই। সেটাই বাস্তব। আমাদের ঠিক করতে হবে, কতখানি শিল্পায়নের জন্য পরিবেশের কতখানি ক্ষতি মেনে নেব। এই ভারসাম্য রেখেই এগোতে হবে।” নয়াচরের ক্ষেত্রে মনমোহন-সরকার কী ভাবে সেই ভারসাম্য রক্ষা করে, এখন তা-ই দেখার। |