ছক কষে খাওয়াদাওয়ার আসরে ডেকে নিয়ে ঘোকসাডাঙার পুটিমারির বাসিন্দা দুই বন্ধুকে খুন করে নদীর চরে ফেলা হয়েছে বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। বুধবার ঘোকসাডাঙ্গা থানার লতাপোতা পঞ্চায়েতের পুটিমারি এলাকার তোর্সার চর থেকে বাবলু রায় (৩৫) ও অমৃত মণ্ডলের (৩৭) দেহ উদ্ধার হয়। ওই ঘটনার তদন্তে নেমে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করেছে পুলিশ। তা থেকেই পুলিশের ওই সন্দেহ দৃঢ় হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, পেশায় সোনার ব্যবসায়ী বাবলু রায় বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার আদলে টাকা জমা রেখে পাঁচ বছরে তা দ্বিগুণ করার কারবার চালাতেন। প্রায় ৭ মাস ধরে তিনি ওই কারবারে যুক্ত ছিলেন। তাঁর বন্ধু অমৃত মণ্ডলও ওই সংস্থায় টাকা রাখতেন। ওই ঘটনা সংক্রান্ত কোনও বিবাদের জেরে পরিকল্পিতভাবে খাওয়া-দাওয়ার আসরে ডেকে নিয়ে তাদের খুন করা হতে পারে বলে পুলিশের সন্দেহ। সেই আসর কোথায় বসেছিল, কারা সেখানে ছিলেন তা পুলিশ খতিয়ে দেখছে। |
এ দিন ওই দুই বন্ধুর খুনের ঘটনা ঘিরে গোলমাল ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ৪ মহিলা সহ ধৃত ৩৩ জনকে এ দিন মাথাভাঙা আদালতে হাজির করানো হয়। সকলেই জামিন পান। মুক্তির পরে তাঁরাও ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতারের দাবি জানান। কোচবিহারের পুলিশ সুপার অনুপ জয়সওয়াল বলেন, “ওই দুই যুবক খুনের ঘটনায় বেশ কিছু তথ্য মিলেছে। নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে। সব খতিয়ে দেখে দ্রুত রহস্যের কিনারা করার চেষ্টা হচ্ছে।”
পুলিশ জানিয়েছে, শুক্রবার মাথাভাঙা মর্গে নিহতদের ময়নাতদন্ত করানো হয়। দুজনের শরীরেই ধারাল অস্ত্রের একাধিক আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে দুই পাশে বাঁশের ছোট টুকরো বাঁধা কয়েক ফুট লম্বা সরু তার। যা অমৃত মণ্ডলের গলায় পেচিয়ে দুষ্কৃতীরা শ্বাসরোধ করেছে। অমৃতবাবু শারীরিক ভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী বলে তার সঙ্গে দু-চারজন পেরে উঠবে না বুঝেই আগেভাগে তারে বাঁশের টুকরো বেঁধে আনা হয় বলে পুলিশের সন্দেহ। তার গলায় প্রায় ৬ ইঞ্চি গভীর ক্ষত দেখে ওই ব্যাপারে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। বাবলু রায়ের বুক, পিঠ ও পেটে ধারাল অস্ত্রের ৮ টি আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। ব্যাপক আক্রোশের জেরে মৃত্যুর পরেও ওই দুজনকে কোপানো হয় বলে পুলিশের অনুমান। নিহতদের পেটে অবশ্য ‘ অ্যালকোহল’ মেলেনি বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে, অমৃতবাবু বুধবার রাত সাতটা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে ছ’বার তাঁর পরিবারের সদস্যদের ফোন করেছিলেন। শেষবার তিনি ফোন করেন তাঁর নবদ্বীপের পিসি সরস্বতী মণ্ডলকে। সরস্বতীদেবী এদিন বলেন, “অমৃত খাওয়াদাওয়ার আসরে ছিল বলে আমাকে জানায়। দুবার আমাকে ফোন করে। কিন্তু পাশে থাকা কেউ তাঁকে ফোনে কথা বলতে বাধা দিচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলে জানায়, তাঁর বন্ধু রয়েছে। পরে বুঝতে পারি, কেউ তার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিল।” সে সময় অমৃত একটি কাশের বনে রয়েছে বলে তার পিসিকে জানায়। পিছনে জঙ্গল ছিল। ওই কথার পরই অমৃতের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। বলে পুলিশ জানতে পেরেছে রাত ১১ টা নাগাদ অমৃত প্রতিবেশী মহিলা সিপিএম নেত্রী মঞ্জুনারা বেগমকে ফোন করেন। মাঞ্জুনারা বলেন, “অমৃত এত রাতে কখনও ফোন করে না। কিছু হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করতেই ফোন কেটে দেয়।”
পরিজনেরা জানান, সোনার ব্যবসায়ী বাবলু ব্যবসার কাজে বুধবার বিকেলে ফালাকাটায় যান। তিনি অমৃতবাবুকে সঙ্গে নেম। বাবলুবাবুর স্ত্রী সরস্বতী রায় বলেন, “অমৃতের আগে এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য নারায়ণ মন্ডল সহ আরও কয়েকজনকে ফালাকাটায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমার স্বামী সেখান থেকে ফেরার পথে রাত সাড়ে ১০ টা নাগাদ কাশিয়াবাড়িতে অর্জুন শর্মার বাড়িতে যান। সেখানে একটি সোনার হার দেন। অর্জুনবাবুকেও পার্টি রয়েছে বলে ওঁরা জানায়।”
পুলিশের ধারণা, রাত সাড়ে ১২টা থেকে দেড়টার মধ্যেই ওই দু’জনকে খুন করা হয়েছে। তার পরে দেহ দুটি নদীর চরে ফেলে দেওয়া হয়। যেখান থেকে দেহ দু’টি উদ্ধার হয়েছে তার পাশে কোথাও খুন করা হতে পারে বলে সন্দেহ পুলিশের। যেখান থেকে দেহ দুটি উদ্ধার হয়েছে, সেখানে রক্তের দাগ ছিল না। যেভাবে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে, তাতে খুনের সময় প্রচুর রক্ত বেরোয় বলে পুলিশের দাবি।
এ দিন বাবলুবাবুর স্ত্রী বলেন, “ব্যবসার সুবাদে দেড় থেকে দু’লক্ষ টাকা বিভিন্ন জনের কাছে পাওনা ছিল স্বামীর। তা নিয়ে কোনওদিন সমস্যা হয়েছিল বলে আমাকে জানায়নি।” নিহত অমৃত মণ্ডলের ভাই অমূল্য বলেন, “বাবলু কয়েকজনের সঙ্গে অর্থলগ্নি সংস্থার আদলে কারবার চালাত। আমার দাদাও সেখানে টাকা রাখত। তা ছাড়া যেখানে দেহ পাওয়া যায়, সেখানে রক্তের চিহ্ন নেই কেন?” এ দিন মৃতদের বাড়িতে যান বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন। তিনি বলেন, “দুষ্কৃতীদের যাতে দ্রুত গ্রেফতার করা হয় সে ব্যাপারে পুলিশের সঙ্গে কথা বলব।”
|