এক মাসের মধ্যেই চুরি হয়েছে মুর্শিদাবাদের উত্তর প্রান্তের দু’টি শতাব্দী প্রাচীন বিগ্রহ। একটি উদ্ধার হয়েছে। অন্যটি এখনও নিখোঁজ। প্রশ্ন উঠেছে, গ্রামে গঞ্জের বিভিন্ন বাড়ি বা মঠ-মন্দিরে পড়ে থাকা এই ধরনের বিগ্রহগুলির নিরাপত্তা কতটা? বস্তুত, কখনও একটি বা দু’টি তালা বা গ্রিলের দরজা ছাড়া বিগ্রহগুলি রক্ষা করার কোনও ব্যবস্থাই নেই। বাকিটুকু ছেড়ে রাখা হয় বিশ্বাসের উপরে। প্রশাসনের সাহায্য প্রায় কিছুই মেলে না। এ কথাও সত্যি যে, প্রশাসনের কাছেও এমন কোনও পরিসংখ্যান নেই, যা থেকে বোঝা যায় কোথায় কী বিগ্রহ রয়েছে। প্রশাসনের দাবি, কোথায় কী বিগ্রহ রয়েছে, তার অর্থমূল্য কী হতে পারে, তা না জেনে তাঁদের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা শক্ত।
জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “কোন মূর্তির কী পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে, সে ব্যাপারে কোনও নথি আমাদের হাতে নেই। যদি সেই তথ্য থাকত, তা হলে আলাদা করে ওই পুরাতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষার ব্যবস্থা করা যেত।” কিন্তু কী ভাবে সেই তথ্য সংগ্রহ করা যাবে? রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপআধিকারিক অমল রায় বলেন, “এই ধরনের মূর্তি বা বিগ্রহগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বা কোনও মঠ বা মন্দিরের অধীন। তাই তাঁরা যদি আমাদের না জানান, আমরা কী করে জানব?” তবে সেই সঙ্গেই তাঁর বক্তব্য, “প্রশাসন যদি আমাদের প্রস্তাব দেয়, তা হলে থানা ভিত্তিক একটা সমীক্ষা করে আমরা কোথায় কী প্রাচীন মূর্তি রয়েছে, তার রিপোর্ট তৈরি করতে পারি। তা গবেষকদেরও কাজে লাগবে।” |
নিমতিতার প্রায় জনহীন রাজবাড়ির মন্দিরের তালা ভেঙে ২৬ অক্টোবর রাতে কষ্টিপাথরের একটি প্রাচীন মূর্তি চুরি করে দুষ্কৃতীরা। প্রায় একই কায়দায় ২৭ নভেম্বর রাতে রঘুনাথগঞ্জের বালিঘাটার শ্যামরাই মন্দির থেকে অষ্টধাতুর প্রায় তিনশো বছরের পুরনো রাধারানির মূর্তি তুলে নিয়ে গিয়েছে চোরেরা। নিমতিতার মূর্তিটির সন্ধান মেলেনি। তবে রাধারানি মূর্তিটি মিলেছে জয়রামপুর এলাকার একটি বাড়ি থেকে। জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে তিন জনকে।
জেলা পুলিশের একটি অংশের অনুমান, মূর্তি চুরি যাওয়ার পরে খুব তাড়াতাড়ি যদি তা উদ্ধার করা না যায়, তা হলে তা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যায়। কেন? পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মুর্শিদাবাদের এক দিকে ঝাড়খণ্ড ও বিহার সীমান্ত এবং অন্য দিকে বাংলাদেশ সীমান্ত। এই দুই সীমান্ত দিয়েই চোরাপাচার চলে। রাধারানির মূর্তিটিও উদ্ধার হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পদ্মা লাগোয়া একটি গ্রাম থেকে। নিমতিতাও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি। একবার বাংলাদেশ বা বিহার-ঝাড়খণ্ডে চলে গেলে সেই মূর্তি আর খুঁজে পাওয়া কার্যত সম্ভব নয়।
মুর্শিদাবাদ এমনিতেই প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আদি মধ্যযুগ থেকে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস সমৃদ্ধ। সাগরদিঘি থেকে কান্দি পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় বহুবার উৎখননও করেছে কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এবং রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতর। সাগরদিঘির হাটপাড়ায় ১৮ হাজার বছর আগের প্রাচীন জনবসতির নিদর্শন মিলেছে বলে জানিয়েছিলেন পুরাতাত্ত্বিকেরা। জেলা থেকে প্রাপ্ত নানা সময়ের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য বছর ছ’য়েক আগে জিয়াগঞ্জে গড়ে উঠেছে জেলা সংগ্রহালয়। কিন্তু বিভিন্ন জমিদার বাড়ি বা মঠ-মন্দিরে রাখা সুপ্রাচীন বিগ্রহগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। জেলা সংগ্রহালয়ের কিউরেটর মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মানুষের বিশ্বাসই বিগ্রহগুলির একমাত্র নিরাপত্তা। গ্রামে-গঞ্জের মানুষও আগলে রাখতে চান তাঁদের মন্দিরের বিগ্রহটি। কিন্তু এই ভাবে সম্পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায় না।”
রাধারানি মূর্তি চুরি করেছিল যে দুষ্কৃতীরা, তাদের জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, স্রেফ ধাতুর মূল্যটুকুই তাদের আকর্ষণ করেছিল। বিগ্রহটি গলিয়ে তা বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল তারা। পুলিশের একাংশর বক্তব্য, ওই মূর্তিই না ভেঙে বিক্রি করলে দুষ্কৃতীরা অনেক বেশি টাকা পেতে পারত। কিন্তু কোথায় গেলে সেই মূর্তি ঠিক দামে বিক্রি করা যাবে, তা তারা জানে না। পুলিশের একাংশের কিন্তু আশঙ্কা, এই জেলায় অনেক মূর্তি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে জানতে পারলে, মূর্তি চোরেরা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। |