গরিমা, নস্ট্যালজিয়া, সংস্কৃতি, বিনোদন সম্মানজ্ঞাপন সবই রয়েছে একুশ ডিসেম্বর ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্-শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে। কিন্তু ময়দানি ভাষায়, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য ‘দ্যাখ ক্যামন লাগে’ ঢঙে কাটা ঘায়ে (পড়ুন পাঁচ গোলের) নুনের ছিটেও যে থাকবে তা কে জানত!
এ দিন ক্লাব তাঁবুতেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর নাম না করে লাল-হলুদ সচিব কল্যাণ মজুমদারের ঘোষণা, “যুবভারতীতে অক্ষয়-সোনাক্ষীদের মঞ্চে সম্মানিত হবেন পঁচাত্তরের আইএফএ শিল্ড ফাইনালের জীবিত সদস্যরাও। দেশের যে কোনও নকআউট টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওটা সব চেয়ে বড় ব্যবধানে (৫-০) জয়ের রেকর্ড।” ক্রীড়ামন্ত্রী এবং ক্লাবের অন্যতম শীর্ষকর্তাকে পাশে বসিয়ে কল্যাণবাবুর এই মন্তব্যের পরই সরগরম ময়দানের ফুটবল মহল। দু’ভাগ সেই ম্যাচে খেলা ময়দানের প্রাক্তনরাও।
প্রায় চার দশক আগে ঐতিহাসিক পাঁচ গোলের ম্যাচে যিনি অতিমানব হয়ে উঠেছিলেন সেই সুভাষ ভৌমিকের গলা থেকেই এল প্রথম প্রতিবাদ। বর্তমানে চার্চিল ব্রাদার্সের টিডি গোয়া থেকে বললেন, “ক্লাবের সিদ্ধান্তকে সম্মান করছি। চেষ্টা করব যাওয়ার। পাঁচ গোল ইতিহাস। কিন্তু ক্লাবের তিরানব্বই বছরের ইতিহাসে এর চেয়ে অনেক বেশি গরিমার অধ্যায় রয়েছে। আশিয়ান কাপ জয় ভুলে গেলেন?”
পঁচাত্তরের উনত্রিশ সেপ্টেম্বর সুভাষদের বিরুদ্ধে সবুজ-মেরুন দুর্গ আগলানোর ভার যার হাতে ছিল সেই সুব্রত ভট্টাচার্য আবার প্রশ্ন তুলছেন এই সংবর্ধনার যৌক্তিকতা নিয়ে। বলছেন, “সংবর্ধনা দিয়ে বাংলার ফুটবল এগোবে? আই লিগে তেরো রাউন্ডের পর বাংলার দলগুলো তেরো-চোদ্দো পয়েন্ট নষ্ট করে এখন মাঝের সারিতে। ওই মঞ্চে এর জন্য একটা শোকসভাও যেন হয়।”
শুনে হাসছেন ওই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলা গৌতম সরকার। ‘ময়দানের বেকেনবাওয়ার’ বলছেন, “বিতর্ক কীসের? মঞ্চে আমাদের দেখলে এখনকার খুদে ফুটবলাররা অনুপ্রেরণা পাবে।” |
২৯ সেপ্টেম্বর,১৯৭৫
সেই পাঁচের একটা। গোল করছেন শ্যাম থাপা। —ফাইল চিত্র। |
৩৯ বছর আগের সেই আইএফএ শিল্ড ফাইনালে পাঁচ গোলের মধ্যে দু’টো গোলই ছিল শ্যাম থাপার। সদ্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরা শ্যাম উচ্ছ্বাস ভরা গলায় বলছেন, “সিক্কা প্যালেসে বছর তেরো আগে একবার সংবর্ধনা হয়েছিল। এ বার একদম প্রাক্-শতবার্ষিকী মঞ্চে সংবর্ধনা। ব্যাপারটা স্বপ্নের মতোই। ক্লাব আমাদের ভোলেনি।”
ওই ম্যাচের আর এক গোলদাতা রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় বলছেন, “নিশ্চয়ই যাব। ওই দলের অশোকলাল, মৃদুলরা আজ পৃথিবীতে নেই। থাকলে আরও ভাল লাগত।”
ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় কী করবেন? সে দিন পাঁচ গোলের চার গোলই যে হয়েছিল তাঁকে টপকে। পরবর্তী জীবনে যিনি ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে। স্ত্রী মলি এখন আবার ইস্টবেঙ্গল কার্যকরী সমিতির সদস্য। ভাস্করের উত্তর, “ইস্টবেঙ্গল কর্তারা যদি বুদ্ধিমান হন তা হলে আমাকে ডাকবেন না।” কিন্তু আপনার ‘বেটার হাফ’ যে আয়োজকদের দলেই। ফোন টেনে নিয়ে মলি বললেন, “ও সে দিন চার গোল খেয়েছিল মনে হলে স্ত্রী হিসেবে খারাপ লাগে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল সমর্থক কিংবা কর্তা হিসেবে ওই দিনটি আমাদের গর্বের। ময়দানে সবাই জানে ভাস্কর আমাদেরই লোক।”
ক্লাবের অন্যতম শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার বলছেন, “শুধু পাঁচ গোল কেন? সে দিন আমাদের অনুষ্ঠান মশাল জ্বালিয়ে শুরু করবেন আর এক প্রাক্তন ফুটবলার পরিমল দে। পাজ ক্লাবের বিরুদ্ধে ওঁর গোলের পরেই তো প্রথম বার লাল-হলুদ গ্যালারিতে মশাল জ্বলেছিল। সেটা মনে রেখেই এই সিদ্ধান্ত।” তিনি আরও বলেন, “কোনও ক্লাবকে আঘাত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। পঁচাত্তরের ওই দলটা পরপর ছ’বার লিগ জিতে রেকর্ড করেছিল। সব গর্বের অধ্যায়ই মাথায় আছে আমাদের। আগামী দিনে ক্লাবকে গর্বিত করা সেই সব নায়কদেরও সম্মানিত করা হবে।” |
“সিক্কা প্যালেসে বছর তেরো আগে একবার সংবর্ধনা হয়েছিল। এ বার একদম
প্রাক্-শতবার্ষিকী মঞ্চে সংবর্ধনা। ব্যাপারটা স্বপ্নের মতোই।
ক্লাব আমাদের ভোলেনি।”—শ্যাম থাপা
|
|
“ইস্টবেঙ্গল কর্তারা যদি বুদ্ধিমান হন তা হলে
আমাকে ডাকবেন না।”—ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় |
|
|
যুবভারতীর এই চার ঘণ্টার লাল-হলুদ সন্ধ্যায় থাকছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একক অনুষ্ঠানও। ইতিমধ্যেই মুম্বই থেকে চলে এসেছে স্বয়ং অক্ষয়ের বার্তা“কলকাতায় যৌবন কেটেছে। জানি ইস্টবেঙ্গলের আবেগ। আসুন আমরা সবাই মিলে সে দিন আনন্দ করি।” সেই আনন্দ আবার লাল-হলুদ জার্সি পরেই করতে চান অক্ষয়-সোনাক্ষীরা। প্রীতমের গানের দলও লাল-হলুদ জার্সিতেই আসর মাতাবেন বলে আগাম জানিয়ে রেখেছেন। ক্লাবের তরফে তাই চল্লিশটা জার্সি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বানাতে পাঠানো হয়েছে পঞ্জাবে। যা আগামী সোমবার ক্লাবে আসার পরেই বিমানযোগে পরদিন চলে যাবে মুম্বই।
অনলাইনে টিকিট বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছে। ছাপা হয়েছে চুয়ান্ন হাজার টিকিট। এরই মাঝে পরের বছরের প্রাক-শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বিশ্ব সেরা এক ফুটবলার এবং ক্লাবকে এনে ‘ফুটবল কার্নিভাল’-এর কথাও এ দিন শুনিয়ে দিয়েছেন কর্তারা।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী গঙ্গাপারের তাঁবুর প্রতিক্রিয়া? পাওয়া যায়নি। যোগাযোগ করা হলে মোহনবাগান সভাপতি টুটু বসুর ফোন বেজেই গিয়েছে। |