পর পর ইট দিয়ে সাজিয়ে তৈরি সারি সারি খুপরি ঘরের ভিতরে দিনের আলোতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরগুলির উচ্চতা মেরে কেটে সাড়ে চার ফুট থেকে পাঁচ ফুট। প্রস্থে মাত্র ২০ বর্গফুট। কিন্তু এই ঘরগুলিতেই থাকেন ৭ থেকে ১০ জন। ঘরের ভিতরেই এক কোণে চলে উনুন জ্বালিয়ে রান্নার কাজ। এই ছবি বর্ধমান জেলার বেশিরভাগ ইটভাটার।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে বর্ধমান জেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ৬০৭টি। প্রতিটি ইটভাটাতে কাজ করেন গড়ে ৩০০ জন শ্রমিক। এই শ্রমিকদের বেশির ভাগই আসেন পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ড ও বিহার থেকে। এ ছাড়াও বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ থেকেও প্রচুর মানুষ এই ইটভাটাগুলিতে আসেন। তাঁরা মরসুমের সময় ইটভাটার খুপরি ঘরগুলিতেই বসবাস করেন। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যেই বেড়ে ওঠে শ্রমিক ও তাঁদের সন্তানরা। বেশির ভাগ ইটভাটাতেই নেই নূন্যতম শিক্ষার ব্যবস্থা ব্যবস্থা। শ্রমিকরা বাড়তি রোজগারের তাগিদে সর্দারের সঙ্গে ইটভাটায় কাজ করতে আসেন। অথচ অতিরিক্ত পরিশ্রম করলেও মেলে না সঠিক মজুরি। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, শীতকালে ইটের ফাঁক দিয়ে ঢোকে ঠাণ্ডা হাওয়া। দিনের বেলাতেও ঘরে আলো জ্বালাতে হয়। নেই শৌচাগার। প্রাকৃতিক কাজকর্মের জন্য ফাঁকা মাঠ, নদীর ধার কিংবা বাঁশ বাগানই ভরসা শ্রমিকদের। মালিকরা অনেক সময় ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের স্থানীয় বাসিন্দা বলে তুলে ধরে বলে অভিযোগ। ফলে তাঁদের থাকার জায়গা নিয়ে সরকারি আধিকারিকেরা প্রশ্ন তুলতে পারেন না।
বিহারের দুমকা জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কাটোয়ার একটি ইটভাটায় কাজ করতে আসা সুখমনি মূর্মু বলেন, “প্রতি সপ্তাহে রোজগারের একটা অংশ সর্দার নিয়ে নেয়। বাকি টাকা থেকে কিছু জমিয়ে গ্রামে পাঠাই।” কালনার পূর্বস্থলীতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন অনিমা কিস্কু। তাঁর কথায়, “মালিক যেখানে থাকতে দেন, সেখানেই কষ্ট করে থাকতে হয়। এ ছাড়া উপায় কী?”
ইটভাটার মালিকদের সংগঠন ‘ব্রিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের’ পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইটভাটাগুলি সাধারণত নদীর ধার বা ফাঁকা মাঠে তৈরি হয়। সেখানে অনেক ফাঁকা জায়গা থাকায় ইটভাটা মালিকেরা নতুন শৌচাগার তৈরি করতে উৎসাহ দেখান না। মালিকদের একাংশের অভিযোগ, শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হলেও শ্রমিকরা সেটা ব্যবহার করেন না। মঙ্গলকোট, পূর্বস্থলী-সহ বিভিন্ন এলাকার ইটভাটা মালিকরা জানিয়েছেন, ওই এলাকাগুলি বন্যাপ্রবণ হওয়ার কারণে শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী ঘর বানানো হয় না।
বর্ধমান জেলার স্বাস্থ্য কর্তারা জানান, ইটভাটা শ্রমিকরা প্রায়ই নানা অসুখ ও অপুষ্টিতে ভোগেন। কালাজ্বরের মত মারাত্মক রোগে তাঁরা আক্রান্ত হন। বর্ধমানের মুখ্য জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণব রায় বলেন, “অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে থাকার জন্যই ইটভাটার শ্রমিকেরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়।” বর্ধমান জেলার অন্যতম সহকারি শ্রম আধিকারিক মহম্মদ হানিফ বলেন, “ইটভাটার মালিকদের ইটভাটা শ্রমিকদের সমস্যার সমাধানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হবে। পরিদর্শকদেরও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে” তিনি আরও জানান, ইটভাটার শ্রমিকরা তাঁদের কাছে সমস্যা নিয়ে মুখ খুলতে চান না। ফলে তাঁদের পক্ষে মালিকদের কিছু বলা সম্ভব হয় না।
জেলার ইটভাটা মালিক সংগঠনের জেলা সভাপতি অসীম বৈরাগ্যের কথায়, “এখন শ্রমিকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। অনেক মালিক শ্রমিকদের পাকা ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন।” তাঁর দাবি, আগের চেয়ে কিছুটা হলেও শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।” বর্ধমান জেলা পরিষদের অন্যতম কর্মাধ্যক্ষ গোলাম জার্জিস জানান, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ইটভাটা গুলিতে ‘কমিউনিটি শৌচাগার’ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
|