চরভাসি/২
পেট চালানোই দায়, পরিবেশ নিয়ে কে ভাবে
নিশ্চিত জীবন। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব।
আঠারো বছরের রোজিনা সদ্য যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আমিনার চরের ওই বাসিন্দা গত পাঁচ বছরে এ নিয়ে তৃতীয়বার মা হলেন। শীর্ণ চেহারার দু’টি শিশুর মোট ওজন এক কিলোগ্রামও হবে কি না সন্দেহ। রোজিনার বুকের দুধও শুকিয়ে গিয়েছে। দু’সপ্তাহের শিশুগুলি বেঁচে রয়েছে কৌটোর দুধের ভরসাতেই।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ফতেমা বললেন, “বুকে দুধ হবে কোথা থেকে? চেহারা দেখেছেন মায়ের?” বন্যা হলেই খেয়া বন্ধ। ধুবুরি না যেতে পারলে বন্ধ হয়ে যায় পুরুষদের রোজগার। সামান্য সঞ্চয় ভাঙিয়েই খাওয়া-দাওয়া। বন্যায় অনশন নিত্যসঙ্গী।
রোজিনার পরিবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘুপচি আধা স্যাঁতসেঁতে ঘরের কোণে ছোট্ট একটি চৌকি। বাকি অংশে ডাঁই হয়ে পড়ে রয়েছে স্তূপীকৃত পাট। আঁশটে গন্ধে ভারী বাতাস। দুর্বল গলায় রোজিনা বলেন, “যমজেরা যখন পেটে তখন প্রথম বন্যা এল। প্রায় পনেরো দিন ভাল করে খাওয়া জোটেনি। তিন বেলার মধ্যে এক বেলা কোনও মতে খেয়েছি।”
বীরসিংহ থেকে মাঝের চর। কিংবা আমিনার চর। রেজিনা, মনোয়ারা কিংবা আয়েষা সকলেরই কম-বেশি একই অবস্থা। প্রতিটি চরেরই যে একই কাহিনি তা স্বীকার করে নিয়েছেন ধুবরি জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক মহিন সুটিয়া। অসহায় স্বাস্থ্য দফতরের বক্তব্য, কোনও চিকিৎসক চরে যেতে চান না। বদলি করা হলেও এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসার তদ্বির শুরু করে দেন। ফলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কমপাউন্ডাররাই ভরসা। তার সঙ্গে আছে সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব। রাজ্য সরকারের হিসাবে, চরের ত্রিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র পাঁচ লক্ষ শিক্ষিত। বাকিরা নিজেদের নাম পর্যন্ত লিখতে জানে না। তাদের কাছে টীকাকরণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতা আশা করাই অন্যায়, মানছেন খোদ সরকারি কর্তারাই।
একমাত্র আশার আলো চরের নতুন প্রজন্ম। মিড ডে মিলের কল্যাণে অন্তত হইহই করে চলছে চরের প্রাথমিক স্কুলগুলি। ধুবরির শিক্ষা অধিকর্তা এ অল আমিনের দাবি, “চরের ছেলেমেয়েরা রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছে মূল ভূখণ্ডের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে।” বীরসিংহ চরের সবথেকে বড় স্কুল ১৩৯ নিম্ন প্রাথমিক স্কুল। প্রথম বন্যার পর কেটে গিয়েছে প্রায় দু’সপ্তাহ। তবুও উঁচু রাস্তার দু’পাশে জমে রয়েছে বন্যার জল। কাদায় থইথই পথ ঘাট। তারই মধ্যে সকাল সাড়ে ন’টার মধ্যেই স্কুলে হাজির প্রায় শ’চারেক পড়ুয়া। স্কুলের শিক্ষক হুসেন আলি আহমেদ এক কালে বীরসিংহ চরেরই বাসিন্দা ছিলেন। এখন বাড়ি করে চলে গিয়েছেন ধুবুরি শহরে। কিন্তু প্রতিদিনই সকালে ফেরি ধরে পৌঁছে যান স্কুলে।
কিন্তু সমস্যার মূল কারণ অর্থাৎ বন্যা রোধে সরকারের কি কিছুই করণীয় নেই? কিংবা স্থানীয় মানুষের? যোরহাটে একক উদ্যোগে পরিবেশরক্ষায় এগিয়ে এসেছেন জাদেব পায়েঙ্গ। ১৯৭৯ সালে বন্যার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বোঝেন, একমাত্র বৃক্ষরোপণই বাঁচাতে পারে চরকে। সেই শুরু গত তিন দশকে প্রায় হাজার একর জমিতে গাছ লাগিয়ে ফেলেছেন তিনি। একই ভাবে মাজুলি রক্ষায় লড়াইতে সক্রিয় রয়েছেন একাধিক সংগঠন ও সরকারি প্রশাসন। তা হলে কোথায় পিছিয়ে বীরসিংহ বা মাঝের চরের মানুষেরা?
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আনএমপ্লয়মেন্ট বিকাশ সমিতির সম্পাদক কোবাড হুসেন সিকদারের কথায়, “সকলেই তো পেটের দায়ে উদয়াস্ত খেটে চলেছে। কার সময় রয়েছে পরিবেশ নিয়ে ভাবার? সরকারি উদ্যোগ ছাড়া কিছু হওয়ার নয়।” অন্য দিকে সরকারের বক্তব্য, তারা গাছ পুঁতছেন। ভূমিক্ষয় রোধে একাধিক প্রকল্পও হাতে নিয়েছেন। কিন্তু সুফল সে ভাবে আসেনি। কারণ বিশ্লেষণে কোবাডের ব্যাখ্যা, “সরকার যেখানে বলবে সেখানেই গাছ পুঁততে হবে। কিন্তু এ বছর যেখানে পোঁতা হল সেই জায়গাটা দেখা গেল পরের বছর ভেঙে গিয়েছে। ফলে গোটা প্রচেষ্টাটাই মাঠে মারা যায়।” যদিও গ্রামবাসীদের দাবি, বৃক্ষরোপণের অনেকটাই খাতায়-কলমে থেকে গিয়েছে।
লোকসভা নির্বাচন দামামা বাজতে শুরু করেছে। আর ক’দিন পরেই শুরু হবে প্রতিশ্রুতির বন্যা। কিন্তু জীবন বদলাবে কি? আশা করাই ছেড়ে দিয়েছেন রুকসানা-মজিদেরা।

(শেষ)

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.