কাকভোরে শর্ট স্ট্রিটে হামলা, গুলি, মৃত্যুর পরে সারা দিন ধরে সংবাদমাধ্যমে একের পর এক বিবৃতি দিয়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে হামলায় আহত নিরাপত্তারক্ষীদের দেখেও আসেন। এই সব খবরই জানত পুলিশ। তবু তাঁকে নিয়ে পুলিশের মনে কোনও সন্দেহ জাগেনি!
কিন্তু ঘটনার পরের দিন পুলিশ যখন ওই ব্যক্তির যোগসাজশের কথা জানতে পারে, তত ক্ষণে গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন অরূপ দেবনাথ। তিনি ৯এ শর্ট স্ট্রিটে জমি দখলের হামলায় অন্যতম চক্রান্তকারী হিসেবে অভিযুক্ত এবং তাঁর সংস্থার নিরাপত্তারক্ষীরাই ওই হামলায় যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ।
১১ নভেম্বরের সেই হামলার পরে এক মাস কেটে গিয়েছে। অরূপকে ধরতে পারেনি পুলিশ। অভিযুক্ত মূল চক্রী পরাগ মজমুদার-সহ ১৬ জন ধরা পড়েছেন। নিরাপত্তারক্ষী সংস্থার মালিক অরূপের খোঁজে বসিরহাটে, সোনারপুর-কামরাবাদে তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালালেও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে গোয়েন্দাদের। তদন্তকারীদের দাবি, অরূপকে ধরা গেলে শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডের অনেক ‘মিসিং লিঙ্ক’ বা লুপ্ত যোগসূত্র সামনে আসবে।
অরূপ যে ওই হামলায় যুক্ত, প্রথম দিন তা বুঝতেই পারেননি তদন্তকারীরা। তাই সুযোগ পেয়েও তাঁরা ঘটনার পরেই তাঁকে গ্রেফতার বা আটক করেননি। ধৃত আইনজীবী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জেরা করে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন, অরূপ ওই হামলায় জড়িত এবং ঘটনার অনেক ‘মিসিং লিঙ্ক’ রয়েছে তাঁর হাতেই। পুলিশের একাংশের অভিযোগ, গোয়েন্দাদের ব্যর্থতাই অরূপকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
প্রথম দিন কেন অরূপকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছিল? সে-দিনই তাঁকে আটক করা হয়নি কেন?
এক পুলিশকর্তা মঙ্গলবার বলেন, “আমরা জানতাম, অরূপের নিরাপত্তারক্ষী সরবরাহের সংস্থা আছে। তাই আমরা তাঁকে নজরে রাখিনি। পরে ধৃতেরা জেরার মুখে হামলাকারী হিসেবে তাঁর নাম বলে।”
প্রাথমিক তদন্তে লালবাজার জানতে পেরেছে, ১১ নভেম্বর ভোরে ৯এ শর্ট স্ট্রিটে জমি দখলের জন্য ২০ জন বাউন্সার ও রক্ষী নিয়ে হামলা চালানো হয়। তাদের নেতৃত্ব দেন আইনজীবী পার্থ। হামলাকারীরা ওই জমিতে ঢোকার পরে সেখানকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রধান
শিক্ষিকা মমতা অগ্রবাল এবং তাঁর ব্যক্তিগত রক্ষীরা গুলি ছোড়েন। গুলিতে দু’জন বাউন্সারের মৃত্যু হয়। ওই বাউন্সার ও রক্ষীদের আনা হয়েছিল সোনারপুরের একটি নিরাপত্তারক্ষী সরবরাহকারী সংস্থা থেকে। অরূপ সেই সংস্থারই মালিক।
প্রধান শিক্ষিকা মমতা, দুই মূল চক্রী বলে অভিযুক্ত পিনাকেশ দত্ত ও পরাগ, আইনজীবী পার্থ এখন শ্রীঘরে। অরূপকে ধরা যাচ্ছে না কেন?
পুলিশ জানায়, হামলার পর থেকেই অরূপ বেপাত্তা। প্রথম দিকে তাঁর মোবাইল চালু থাকলেও পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। গোয়েন্দারা তাঁর খোঁজে বসিরহাট এবং কামরাবাদের বাড়িতে। তদন্তকারীরা তাঁর পরিবারের লোকেদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছেন, তাঁদের আত্মীয়েরা আছেন বাংলাদেশে। বসিরহাটের বাড়ি থেকে অরূপের বাংলাদেশে পালানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ।
তদন্তকারীরা জানান, অরূপের সংস্থার কোনও অফিস নেই। কামরাবাদের বাড়ি থেকেই তিনি রক্ষী সরবরাহ করতেন। শর্ট স্ট্রিটে জমির দখল নেওয়ার জন্য পার্থ বাউন্সার ও রক্ষী ভাড়া করেছিলেন অরূপের কাছ থেকেই। আর পার্থকে ওই দায়িত্ব দেন জমি-বাড়ির কারবারি পিনাকেশ। বাউন্সার ও রক্ষী সরবরাহের জন্য তিনি অরূপকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন বলে গোয়েন্দারা জানান।
হামলায় অরূপ কী ভাবে যুক্ত?
গোয়েন্দারা জানান, হামলার ভোরে পিনাকেশের সঙ্গে ওই বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিলেন অরূপ। গুলি চালানোর খবর জানাজানি হওয়ার পরে অরূপ দাবি করেন, তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। কী কাজের জন্য তাঁর সংস্থার নিরাপত্তারক্ষী ভাড়া করা হয়েছিল, তা-ও জানতেন না বলে দাবি করেন তিনি। তবে পিনাকেশের দাবি, এক বছরের জন্য অরূপের সংস্থার সঙ্গে তাঁদের চুক্তি হয়েছিল।
লালবাজারের এক কর্তা এ দিন বলেন, “অরূপকে ধরার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। তাঁকে ধরা গেলে জানা যাবে, হামলার দিন আর কে কে ঘটনাস্থলে ছিল।” অরূপের দুই সঙ্গীকেও খুঁজছে পুলিশ।
শুধু অরূপ নয়। আইনজীবী এবং ব্যাঙ্কের এক প্রাক্তন ‘রিকভারি এজেন্ট’ সমীর রিয়াজেরও খোঁজ চলছে। গত সপ্তাহে তাঁর খোঁজে বারাণসীতে হানা দেন কলকাতার এক দল গোয়েন্দা। কিন্তু তাঁরা সেখানে সমীরের শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছনোর আগেই অভিযুক্ত পালিয়ে যান। সমীর ওখানে আত্মগোপন করে ছিলেন বলে পুলিশের দাবি। সমীরের ভাটপাড়ার বাড়িতেও হানা দেন গোয়েন্দারা। পুলিশের দাবি, নভেম্বরের আগে, ১৫ সেপ্টেম্বরও শর্ট স্ট্রিটের ওই বাড়িতে হামলা হয়। তার নেতৃত্বে ছিলেন সমীর। তাঁকে ধরতে পারলে শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডের অনেক আজানা তথ্য মিলবে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। জেরায় ধৃতদের এক জন জানান, ওই জমি দখল করার জন্য সমীরকে ১৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন পিনাকেশ।
|