পুরসভার পাইপলাইন বসানোর কাজ করতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে মঙ্গলবার মৃত্যু হয়েছে এক ঠিকাকর্মীর। শ্রমিকদের অভিযোগ, নিরাপত্তায় গাফিলতির জেরেই এই দুর্ঘটনা। পুরকর্তারা অভিযোগ মানতে না চাইলেও এই ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের অভিমত, মাটি কেটে কাজ করার ক্ষেত্রে যে ধরনের সাবধানতার ব্যবস্থা রাখার কথা, এ ক্ষেত্রে তা ছিল না। ঘটনায় সত্যিই নিরাপত্তাজনিত গাফিলতি ছিল কি না, খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।
এ দিন দুপুরে মাঝেরহাট উড়ালপুলের কাছে জলের পাইপলাইন বসানোর ওই কাজ চলছিল। সেখানেই মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু হয় বাবলু শেখ (৪১) নামে ওই ঠিকাকর্মীর। মাথায় চোট পান খুরান শেখ নামে আর এক ঠিকাকর্মীও। দু’জনেরই বাড়ি মুর্শিদাবাদের নসিপুরে। ওখানে কর্মরত অন্য শ্রমিকদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকাতেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পরেই কাজ বন্ধ করে দেন তাঁরা। যদিও পুরসভার পক্ষ থেকে অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
শ্রমিকদের তোলা অভিযোগ ঘিরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। ওই কাজে যুক্ত শ্রমিকদের একাংশের বক্তব্য, মাটি কেটে কাজ করার সময়ে গর্তের উচ্চতার পুরোটাই দু’দিকে লোহার রড এবং কাঠ দিয়ে ঘিরে দেওয়ার কথা। যাতে মাটি ধসে নেমে এলেও তা আটকানো যায়। এ ক্ষেত্রে সে রকম কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। তাঁরা জানান, পাশেই মাটি খুঁড়ে সিইএসসি-র কেব্ল বসানোর কাজ চলছে। সেখানে কাজের পুরো জায়গাটি লোহার রড এবং কাঠ দিয়ে ঘিরে রাখা। শ্রমিকদের এই যুক্তি অবশ্য মানতে নারাজ কলকাতা পুরসভার জল সরবরাহ দফতর। তাঁদের বক্তব্য, জলের পাইপলাইন বসানো হয় মাত্র ৫-৬ ফুট গভীরতায়। সেখানে নিরাপত্তার জন্য আলাদা করে কোনও কাঠামো গড়ার দরকার হয় না। তাই এখানেও তা ছিল না। যদিও রাজ্য সরকারের এক বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার বলেন, “মাটির নীচে কাজ করতে হলে দু’পাশে মাটির চাপ ধরে রাখতে লোহার রড ও কাঠের কাঠামো করা দরকার। তা না হলে বিপদের সম্ভাবনা থেকেই যায়।” অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে যে তা মানা হয়নি, ওই ইঞ্জিনিয়ারের বক্তব্যেই তা পরিষ্কার। নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকলে এমন ঘটত না বলে মনে করছেন ওই শ্রমিকেরা।
পুরসভা সূত্রের খবর, ডায়মন্ড হারবার রোডে জোকা-বিবাদী বাগ মেট্রোর কাজ চলছে। মাঝেরহাট উড়ালপুলের কাছে তার স্তম্ভ বসানো হবে। সে জন্য বেশ কিছুটা সরাতে হবে জলের পাইপলাইন। জল সরবরাহ যাতে বিঘ্নিত না হয়, তার জন্য নতুন জায়গায় ৩৬ ইঞ্চি পাইপলাইন বসানোর কাজ শুরু হয়েছে মাস দুয়েক আগেই। এ দিন সকালেও মাটি খোঁড়ার কাজ চলছিল। কাজ করছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারের কর্মীরা।
পুলিশ জানায়, দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ মাটির একাংশে ধস নামে। দু’জন শ্রমিক আহত হন। অচৈতন্য অবস্থায় বাবলুকে একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মাথায় চোট লাগা খুরান শেখকে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দুর্ঘটনার সময়ে উপস্থিত ছিলেন আব্দুল হালিম নামে এক শ্রমিক। তিনি জানান, সকালে তিনি আরও চার জনের সঙ্গে জলের পাইপ বসানোর ওই কাজ করছিলেন। আব্দুলের কথায়, “বাবলু যেখানে মাটি কাটার কাজ করছিল, ঠিক তার উপরেই মাটির পাহাড় জমে ছিল। কোদালের কোপ মারতেই প্রচুর মাটি এবং ইট একসঙ্গে ধসে পড়ে ওর উপরে। আচমকা এতটা মাটি একসঙ্গে পড়ায় দৌড়ে পালাতে পারেনি বাবলু।” তিনি জানান, এর পরেই বাকি শ্রমিকেরা মিলে আহতদের বাইরে নিয়ে আসেন।
কলকাতা পুরসভার এই কাজটির সঙ্গে যুক্ত থাকা এক বেসরকারি সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য এ দিন বলেন, “কাজের জায়গাটা এতটাই সংকীর্ণ যে সেখানে লোহার রড এবং কাঠ দিয়ে কাঠামো তৈরি করার জায়গা নেই। ওখানে কাজ করতে হলে শ্রমিকদের এ ভাবেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হবে।” যদিও এই ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “এই ঘটনায় নিরাপত্তাজনিত কোনও গাফিলতি ছিল কি না, তা দেখতে বলেছি। যে সংস্থা ওই কাজের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলবেন পুরসভার কর্তারা।” মেয়র জানান, নিয়ম মতোই মৃত শ্রমিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেবে ঠিকাদার সংস্থা। এ দিকে, দুর্ঘটনার পরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন শ্রমিকেরা। পুরসভা সূত্রের খবর, আপাতত কাজ বন্ধ করে গর্ত বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা পুরসভার জল সরবরাহ বিভাগের ডিজি বিভাস মাইতি বলেন, “রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু বলতে পারব না।” |