আটচল্লিশ বছর আগের কথা। তবু এখনও তারিখটা মনে আছে। ৯ মে, ১৯৬৫। মনে আছে, কারণ ওই দিনই প্রথম বার মোহনবাগানের খেলা দেখতে মাঠে আসা আমার। বিদ্যুৎ মজুমদারকেও সেই প্রথম দেখা। চুনী গোস্বামী, জার্নেল সিংহ, রহমান, অরুময়নৈগম, অশোক চট্টোপাধ্যায়দের দেখতে এসে মন ভরে গিয়েছিল বিদ্যুৎদার খেলায়।
এখনও মনে আছে, আমি আর আমার পাড়ার বন্ধু সুভাষ ৪৫ পয়সার টিকিট কেটে মাঠে ঢুকেছিলাম। মাথায় সবুজ-মেরুন ফেট্টি। হাতে পতাকা। মনের ভেতর দারুণ উত্তেজনা। কিন্তু ম্যাচটা ড্র হওয়ায় দিনের শেষে যখন সব কিছু মাটি হয়ে যাচ্ছে, তখনই দেখি মাঠে এক জন ফুটবলার মাথায় হাত দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আছে। চুনীদারা ড্রেসিংরুমে ঢুকে যাওয়ার পরে যখন সেই ফুটবলার মাথা তুলল, মনে হল তার চোখে জল! ওই প্রথম বারেই বিদ্যুৎদাকে দেখে একটা জিনিস উপলব্ধি করেছিলাম মোহনবাগানে খেলা মানে শুধুই ফুটবল নয়। আবেগ, ভালবাসা এবং প্রচুর দায়বদ্ধতাও। |
’৬৭-র লিগজয়ী মহমেডান। বাঁ দিক থেকে ষষ্ঠ বিদ্যুৎ মজুমদার।—ফাইল চিত্র। |
বিদ্যুৎদা কাঁদতেও জানতেন, হাসতেও জানতেন। মোহনবাগানের হারে যেমন কাঁদতে দেখেছি, তেমনই আটষট্টিতে হাওড়া ইউনিয়নে খেলার সময় তাঁকে দলের জয়ে টিমমেট অশোক চট্টোপাধ্যায়কে জড়িয়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তেও দেখেছি। তার চার বছর পর আমি বিদ্যুৎদার বিরুদ্ধে ম্যাচও খেলেছিলাম। বাহাত্তরে আমি তখন বিএনআরে। বিদ্যুৎ মজুমদার দারুণ বলপ্লেয়ার ছিলেন, সেটা হয়তো বলা যাবে না। কিন্তু অসম্ভব পরিশ্রমী ফুটবলার ছিলেন। সে সময় ৩-২-৫-এ খেলা হত। ওই ফর্মেশনে মোহনবাগানে বিদ্যুৎদার পজিশন ছিল মাঝমাঠে বিমল চক্রবর্তীর পাশে। নিখুঁত পাসিং আর বল সাপ্লাইয়ের জন্য বিখ্যাত বিদ্যুৎদার অবশ্য মাথাগরম ফুটবলার হিসাবেও পরিচিতি ছিল। রেফারির সঙ্গে অনেক বার ঝামেলায় জড়িয়েছেন। তবে নতুন ছেলেদের উৎসাহ দিতেন। এখনও মনে আছে, পঁচাত্তরে মোহনবাগানের দুর্দিনে কী ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু যে পরিশ্রম আর নিষ্ঠা দিয়ে ফুটবলটা খেলতেন, সেই তুলনায় পরিচিতি পাননি এখানকার ফুটবল-সমাজে। এক রকম ব্রাত্য হয়েই থাকলেন।
খুব খারাপ লাগছে, বিদ্যুৎদার মতো এক জন ফুটবলার নীরবে চলে গেলেন, কেউ জানতেই পারল না। অথচ পঞ্চাশের শেষ থেকে সত্তর দশকের শুরু পর্যন্ত দাপিয়ে খেলেছেন তিন প্রধানেই। ’৬৭-তে কুয়ালা লামপুরে মারডেকায় ভারতীয় দলে অরুণ ঘোষ, নইমুদ্দিনদের সতীর্থ। মোহনবাগান, মহমেডানে লিগ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার অধিনায়ক। ভারতীয় ফুটবলে বিদ্যুৎদার অবদান থাকলেও মৃত্যুকালে তাঁর পাশে কোনও ক্লাব দাঁড়ায়নি। মালা পর্যন্ত পাঠায়নি।
বিদ্যুৎদার কথা বলতে গিয়ে আমার এক মহান কবির লেখা মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘যে রাগে না, হাসে...যে কাঁদে না, ভালবাসে সে-ই সফল হয় এই সমাজে।’ কিন্তু বিদ্যুৎদা হাসতেও জানতেন, রাগতেও জানতেন। হয়তো তাই সফল হননি! |