যে কোনও সরকারের সম্মুখে একটি মৌলিক প্রশ্ন: কী করিতে হইবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ধারণ করিয়াই সরকার আপন নীতি এবং কার্যক্রমগুলি রচনা করে। সমালোচকরাও তাহা লইয়াই সমালোচনা করেন। এই দেশে, বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে অন্য একটি মৌলিক প্রশ্ন অবহেলিত থাকিয়া যায়। সেই প্রশ্ন: কী করিতে হইবে না? সরকার আপন কাজ কেন করিতেছে, তাহাই আলোচিত হয়, যাহা তাহার কাজ নয় তাহা সরকার করিতেছে কি না, সেই বিষয়ে কেহ কথা বলে না সরকার তো বলেই না, তাহার সমালোচকরাও বলেন না। অথচ প্রশ্নটি কোনও অংশে কম গুরুতর নহে। অনেক সমস্যাই জটিলতর হয় এই কারণে যে, সরকার আপন কর্তব্যে যথেষ্ট মন না দিয়া বিবিধ অকর্তব্য সাধনে ব্যস্ত হয়। এই নিতান্ত সহজ সত্যটি সচরাচর কেহ লক্ষ করেন না। কারণ এই সমাজে ধরিয়া লওয়া হয় যে, জনসাধারণের জন্য যাহা করিবার, সবই সরকারকে করিতে হইবে, এবং নিজ হাতে করিতে হইবে। তাহার কারণ: সরকার এখানে জনকজননী হিসাবে গণ্য হয়। কেহ যদি বলেন, স্বাধীনতার বয়স তো প্রায় সত্তর হইল, এখনও জনকজননীকে কেন সন্তানদের দায়িত্ব লইতে হইবে? সদুত্তর মিলিবে না, কারণ সদুত্তর নাই।
বামফ্রন্ট আমলে সরকার বিবিধ বেসরকারি উদ্যোগীর সহিত যৌথ ভাবে নানা আবাসন প্রকল্প শুরু করিয়াছিল। এমন কিছু প্রকল্পে বেনিয়মের অভিযোগ লইয়া বর্তমান সরকার তদন্ত করাইতেছে। অধুনা নবান্ন হইতে নূতন সিদ্ধান্তের সংবাদ মিলিয়াছে। সংশ্লিষ্ট বেসরকারি উদ্যোগীদের সম্পর্কে যথেষ্ট অনুসন্ধান ও পর্যালোচনার পরে সরকার স্থির করিবে, তাহাদের সহিত নূতন করিয়া যৌথ আবাসন প্রকল্পের জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়া যায় কি না। অর্থাত্, পূর্ববর্তী জমানার যৌথ আবাসন প্রকল্পের পরিবর্তে এ বার পরবর্তী জমানার যৌথ আবাসন প্রকল্প। নবান্নের নীতিকাররা যথারীতি গোড়ার কথাটি ভাবিয়া দেখিলেন না। সরকার কেন আবাসন প্রকল্পের অংশীদার হইবে? গৃহনির্মাণ কি সরকারের কাজ? ভাবিয়া দেখিলেন না, কারণ বর্তমান নীতিকাররাও এই বিষয়ে তাঁহাদের পূর্বসূরিদের ন্যায়ই মনে করেন, গৃহনির্মাণ সরকারের কাজ। চিন্তার ধারা বদলায় নাই বলিয়াই বাহিরের পরিবর্তন বাহিরেই থাকিয়া গিয়াছে।
দরিদ্র বা মধ্যবিত্তের আবাসন সমস্যার সমাধানে সরকারের ভূমিকা থাকিতেই পারে। কোথায় সেই ভূমিকার সীমা টানা হইবে, তাহা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু সেই ভূমিকা পালনে সরকারের আবাসন প্রকল্পের শরিক হইবার প্রয়োজন নাই। জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে সরকার যে সুযোগ দিতে চাহে, তাহা বেসরকারি উদ্যোগীকেই দেওয়া সম্ভব। বাজারের তুলনায় কম দামে জমির ব্যবস্থাই হোক, ঋণ বা রাজস্বে বিশেষ সুবিধা হোক, অন্য কোনও উত্সাহ হোক, সরকার নানা ভাবেই আবাসন নির্মাণে সহযোগিতা করিতে পারে। বিনিময়ে স্বল্প আয়ের ক্রেতাদের জন্য নির্দিষ্ট অনুপাতে আবাসন বরাদ্দ রাখিবার শর্ত চুক্তির অঙ্গ হইতে পারে। বেসরকারি উদ্যোগী ইহা মানিয়াই চুক্তি করিবেন, নচেত্ বিশেষ সুযোগসুবিধা পাইবেন না। কিন্তু ইহার জন্য ‘যৌথ উদ্যোগ’ সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থ পরিবর্তন আনিতে চাহিলে তাঁহাকে নূতন করিয়া ভাবিতে হইবে। নূতন প্রশ্ন তুলিতে হইবে। কী করিবেন না, তাহা স্থির করিতে হইবে। অন্যথায় তিনি এক দিন আবিষ্কার করিবেন, নবান্নেও মহাকরণের ঐতিহ্যই সমানে চলিতেছে। |