কাজ থাকিলেও যে সরকারি কর্মীরা অনেক সময় কাজ করেন না, সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীই সেই কথা বলিয়াছেন। কিন্তু কাজ না থাকিলে? যাঁহারা কাজে ফাঁকি দেন, তাঁহাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা বিধেয়। কিন্তু সরকার যে কর্মীদের কাজ দিতে পারে না, তাঁহাদের লইয়া কী করা যায়, সেই প্রশ্নটির উত্তর বামপন্থীরা খুঁজিয়া পান নাই। কিন্তু তাহাতে প্রশ্নটি হারাইয়া যায় নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নূতন করিয়া সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিবার চেষ্টা করিতেছেন। একটি হিসাব বলিতেছে, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সরকারি দফতরে এমন ‘কর্মহীন’ কর্মী শতকরা ত্রিশ জন। সরকারি হিসাব, ফলে তাহাতে উত্পাদনশীলতার অঙ্কটি কষা হয় নাই বলিয়াই অনুমান। কর্মীরা প্রকৃতার্থে উত্পাদনশীল হইলে উদ্বৃত্ত কর্মীর অনুপাত আরও বাড়িবে। এই বিপুল উদ্বৃত্ত কর্মিবর্গ আক্ষরিক অর্থেই বিনা কাজে বেতন পান। মাসের পর মাস, বত্সরের পর বত্সর। বাম আমলে কো-অর্ডিনেশন কমিটির দাপটে কর্মহীন কর্মীদের বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা করিবার সাহস সরকারের হয় নাই। বর্তমান সরকার সেই চেষ্টা করিতেছে। মুখ্যসচিব নির্দেশ দিয়াছেন, রাজ্য সরকারের সমস্ত দফতর, তাহার অধীন সকল সংস্থার উদ্বৃত্ত কর্মিবর্গকে চিহ্নিত করিতে হইবে এবং ছয় মাসের মধ্যে উদ্বৃত্ত কর্মীদের ভিন্ন কাজে লাগানো হইবে।
উদ্বৃত্ত কর্মীর সংজ্ঞা মুখ্যসচিব স্থির করিয়া দিয়াছেন যে কর্মীর হাতে যথেষ্ট কাজ নাই। আপাতদৃষ্টিতে ঠিক, কিন্তু এই সংজ্ঞায় উত্পাদনশীলতার প্রশ্নটি ঠাঁই পায় না। একটি দফতরে মোট যত কাজ আছে, সেই কাজ করিতে যত জন যথার্থ উত্পাদনশীল কর্মীর প্রয়োজন হয়, তাহার অতিরিক্ত যত কর্মী দফতরে আছে তাঁহাদের প্রত্যেকেই উদ্বৃত্ত। সাত জনে মিলিয়া এক পাতা লিখিলে তাহা সাত জনের কাজ হইতে পারে না। দ্বিতীয়ত, কোন কর্মী প্রয়োজনীয় আর কে উদ্বৃত্ত, তাহা দফতরের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে বোঝা সম্ভব নহে। সেই প্রক্রিয়া বস্তুনিরপেক্ষ হইতে পারে না। উদ্বৃত্ত কর্মীদের চিহ্নিত করিতে হইলে বহিরাগত মূল্যায়ক প্রয়োজন। এই বিচারের প্রক্রিয়ায় দফতরের কর্তাকেও শরিক করিতে হইবে বটে, কিন্তু তিনিই একমাত্র বিচারক হইতে পারেন না। বিচারকমণ্ডলী নিরপেক্ষ মাপকাঠি ব্যবহার করিয়া বলিয়া দিবেন, কত জন কর্মী যথার্থ উত্পাদনশীল এবং প্রয়োজনীয়। কাজটি কঠিন নহে। সরকারি দফতরের অচলায়তনের বাহিরে যে পৃথিবী, তাহাতে কর্মীদের বার্ষিক (এমনকী ষাণ্মাসিক) মূল্যায়নই প্রথা। কাজেই, নূতন করিয়া চাকা আবিষ্কার করিবার প্রয়োজন নাই মূল্যায়নের প্রচলিত পদ্ধতিগুলির মধ্যে যাহা সর্বাধিক উপযোগী, সেটিকেই গ্রহণ করা বিধেয়। সর্বাধিক উত্পাদনশীল যে কর্মীরা দফতরের কাজের জন্য অপরিহার্য, তাঁহাদের রাখিয়া বাকিদের উদ্বৃত্ত হিসাবে চিহ্নিত করিয়া দিতে হইবে।
এই উদ্বৃত্ত কর্মীদের দফতরে রাখিয়া দিলে চলিবে না। তাঁহাদের জন্য একটি পৃথক ব্যবস্থা করিতে হইবে কর্পোরেট দুনিয়ায় যাহা ‘বেঞ্চ’ নামে পরিচিত। তাঁহাদের কোনও কাজ থাকিবে না, দফতরও থাকিবে না তাঁহারা শুধু উপস্থিতির জন্যই বেতন পাইবেন। এই ব্যবস্থাটি অনন্ত কালের জন্য নহে যত ক্ষণ না অন্য কোনও দফতরে নূতন কর্মীর প্রয়োজন পড়িতেছে, তত দিন। যে দফতরে কর্মী প্রয়োজন হইবে, বেঞ্চ হইতেই তাহা জোগান দেওয়া হইবে। বেঞ্চের কর্মী ফুরাইলে অথবা বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হইলে তবেই নূতন নিয়োগের কথা ভাবা হইবে। যেহেতু বেঞ্চের কর্মীরা তুলনায় কম উত্পাদনশীল, তাঁহাদের কুশলতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যাইতে পারে। সেই প্রশিক্ষণে সফল না হইলে বেতন, পদোন্নতি ইত্যাদিতে তাহার প্রভাব পড়িবে। কিন্তু, বিনা কাজে দফতরে বসিয়া বেতন পাইবার ব্যবস্থাটি এই বার শেষ করাই বাঞ্ছনীয়। |