নারী ও পুরুষ লইয়া মানুষের মাথাব্যথার শেষ নাই। নারীবাদ প্রস্ফুরণের ঢের আগে হইতেই এই মাথাব্যথা চলিয়া আসিতেছে। পৌরুষ এবং নারীত্বের মধ্যে পার্থক্য কোথায়, সম্পর্কই বা কী, সে কালের মনুসংহিতাও তাহা লইয়া আলোচনা করিতে বাকি রাখে নাই। এখন, এই একবিংশ শতকে যদি শোনা যায়, বৈজ্ঞানিকদের আবিষ্কার নারী ও পুরুষের মস্তিষ্কের মধ্যে বিস্তর তফাত, আধুনিক মন স্বভাবতই সন্দিহান ও উদ্বিগ্ন হইয়া উঠে। এই বুঝি নারীদের ‘পশ্চাতে’ রাখিবার আবার বিশদতর বন্দোবস্ত চলিতেছে। তবে যতই উদ্বেগ হউক, এমনই দাবি করিতেছেন পেনসিলভ্যানিয়া ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের গবেষক-দল, যাঁহাদের নেতৃত্বে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক কন্যা, নাম রাগিণী বর্মা।
আবিষ্কারের মূল কথা: পুরুষ-মস্তিষ্ক ও নারী-মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতিতে কাজ করে তাহাদের ব্যবহার-বৈষম্য ও চিন্তাবৈষম্যের ব্যাখ্যা লুকাইয়া আছে এই কর্মপদ্ধতিগত বিভিন্নতার মধ্যেই। পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও তন্নির্ভর সুসংবদ্ধ ক্রিয়াক্ষমতা পুরুষের মস্তিষ্কে বেশি। আবার বিশ্লেষণাত্মক ও অন্তর্বোধমূলক মস্তিষ্কক্রিয়া মহিলাদের বিশেষত্ব। রাগিণী বর্মা বলিবেন, ‘সোশ্যাল স্কিলস্’ বা সামাজিক ব্যবহার-দক্ষতার ক্ষেত্রে সেই কারণেই মহিলারা বিশেষ পারদর্শী, পুরুষরা স্বভাবত পিছাইয়া। এবং যেখানে ক্রিয়া-সমন্বয়ের মাধ্যমে শারীরিক সক্ষমতা একত্র করা প্রয়োজন, সেখানে পুরুষরা মহিলাদের অপেক্ষা আগাইয়া। অর্থাত্ গাঠনিক দিক দিয়াই পুরুষ ও মহিলা আলাদা, ইহাই এই নূতন গবেষণার বক্তব্য। শারীর-গাঠনিক বিশেষত্বের কারণেই আলাদা আলাদা কাজে পুরুষ ও মহিলা মস্তিষ্কের বিশেষ দক্ষতা জন্মায়। শুনিতে যতই আপত্তিকর হউক, ভাবিয়া দেখিলে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে গাঠনিক প্রভেদ থাকিবার কিন্তু কোনও বাধা নাই! বাহ্যিক অভ্যন্তরীণ বহু তফাতের কথাই আমরা জানিয়া ফেলিয়াছি, হয়তো এখনও কিছু অভ্যন্তরীয় পার্থক্যের কথা অজানা। নারীবাদীদের উদ্বেগের কারণ নাই। নারী ও পুরুষের সমতার অর্থ সর্বপ্রকার প্রাকৃতিক বিষমতা অবজ্ঞা ও অগ্রাহ্য করা নহে। তাহার প্রয়োজনও নাই সামাজিক সাম্য কোনও শারীরিক সাম্যের উপর শর্তসাপেক্ষ হইতে পারে না। এক কালে জাতি-বিভিন্নতারও শারীর-গাঠনিক তত্ত্ব দিবার চল আসিয়াছিল, সংশয়ীদের মনে পড়িতে পারে। কিন্তু তাহা হইতে এই তর্ক আলাদা। প্রথমত, জাতিবৈষম্যের ক্ষেত্রে কেবল বাহ্যিক পার্থক্যেরই প্রমাণ মিলিয়াছে। কোনও অ্যাংলো-স্যাক্সন পুরুষ ও আফ্রিকার উপজাতীয় পুরুষের মধ্যে গাত্রবর্ণ ভিন্ন শারীরিক কোনও বৈষম্য প্রমাণিত হয় নাই। এ দিকে লিঙ্গভেদে শরীরাভ্যন্তরের বিবিধ বৈষম্য সন্দেহের অতীত। আসলে একটি স্পষ্ট উপলব্ধি দরকার: মানুষের একটি জৈবিক সত্তা ও একটি সামাজিক সত্তা। জৈবিক বৈসাদৃশ্য স্বাভাবিক। কিন্তু সামাজিক বৈসাদৃশ্য অ-স্বাভাবিক ও অবাঞ্ছনীয়। যতই শারীরিক তফাত থাক, সামাজিক জীব হিসাবে সকলের একই মূল্য। তাহার জন্য প্রকৃতি বা বিজ্ঞান কাহাকেও অস্বীকার করিবার দরকার নাই। সামাজিক জীব হিসাবে সকলের এক অধিকার, এক কর্মযোগ্যতা। যদি জানা যায়, কোনও কোনও দক্ষতায় একে অপরের অপেক্ষা আলাদা, তাহা মানিয়া লইয়াও অধিকার ও ক্ষমতার সমতল রচনা করা যায়। মেয়েদের ছেলে হইবার কিংবা ছেলেদের মেয়ে হইবার সাধনা ব্যতিরেকেই সেই সমতলে পৌঁছনো সম্ভব। |