আপন জনজাতি, প্রদেশ ও দেশের ভূগোল অতিক্রম করিয়া সমগ্র দুনিয়ার মানুষ হইয়া উঠিতে পারেন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা কোনও যুগেই বেশি নয়। তেমনই এক বিরল মানুষ বিদায় লইলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে, অর্থনীতির রূপকার হিসাবে, বাস্তববাদী কূটনীতির চালক হিসাবে কতটা সফল, তাহা লইয়া তর্ক আছে, থাকিবে। কিন্তু তিনি যে আক্ষরিক অর্থেই এক জন যুগপুরুষ, সেই বিষয়ে কোনও বিতর্ক নাই। তাঁহার প্রকৃত কৃতি এবং কৃতিত্ব ইহাই যে, ম্যান্ডেলা একটি দ্বন্দ্বপ্রাণ সমাজ এবং রাজনীতিকে বোঝাপড়ার পথে ভারসাম্যে আনিয়াছিলেন। যাহাকে ক্ষমার ধর্ম বলে, তিনি সেই ধর্মকে হাতে-কলমে অনুশীলন করিয়া রাষ্ট্রনীতিতেই তাহার কুশলী ব্যবহার করিয়াছিলেন। যখন বর্ণবৈষম্যের ব্যবস্থার অবসানে দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্ষমতা হাতে পাইলেন, তখন তাঁহাদের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি শ্বেতাঙ্গদের এত কালের অত্যাচার, অপমান ও শোষণ ফিরাইয়া দিতে পারিতেন। দেশবাসীর দাবিও তেমনই ছিল। কিন্তু ম্যান্ডেলা প্রতিহিংসার পথে যান নাই, বরং পীড়ন ও শোষণের, বিভেদ ও ভাঙনের ভিত্তিকেই আঘাত করিলেন ভালবাসা, ক্ষমা ও মিলনের আদর্শ দিয়া।
মনে রাখিতে হইবে, নেলসন ম্যান্ডেলার এই ‘ক্ষমা’ কোনও বায়বীয় আদর্শ নহে, তাহা দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবের উপযোগী একটি নীতি, বস্তুত এই নীতি ভিন্ন দেশকে অখণ্ড রাখাই তখন অসম্ভব ছিল। ‘চোখের বদলে চোখ’ উপড়াইয়া লওয়ার নীতি যে সমগ্র সভ্যতাকেই একদিন অন্ধ করিয়া দিবে, গাঁধীজির এই বাণী তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষদীর্ণ সমাজে প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজকে পরিবর্তিত করিতে হইলে আগে নিজেকে যে সেই পরিবর্তন ‘হইতে হইবে’, এই বাণীও ম্যান্ডেলা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করিয়াছেন। তাই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের অবসান আফ্রিকায় কোনও রক্তস্নানের মধ্য দিয়া ঘটে নাই, গণতান্ত্রিক ক্ষমতা-হস্তান্তরের মধ্য দিয়া ঘটিয়াছে। কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকা কোনও জাতিদাঙ্গা দেখে নাই, কারণ ম্যান্ডেলার পৌরোহিত্য জাতিবৈর প্রশমিত করিয়াছে। আর এই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকায় গড়িয়া উঠিয়াছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, জাতিবর্ণগত সংগঠনের রামধনু কোয়ালিশন।
নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে ভারত পাঁচ দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করিতেছে। ভারতের সহিত ম্যান্ডেলার সম্পর্ক কেবল গাঁধী ও আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস সূত্রে নয়। শ্বেতাঙ্গশাসিত বর্ণবিদ্বেষী প্রিটোরিয়াকে তাহার বিভেদকামী রাষ্ট্রনীতি বর্জনে চাপ দিতে নয়াদিল্লি দীর্ঘ কাল তাহার সহিত যাবতীয় কূটনৈতিক, ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছেদ করিয়াছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক মঞ্চে জওহরলাল নেহরু হইতে ইন্দিরা গাঁধী পর্যন্ত সকলেই ক্রমাগত প্রিটোরিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারির জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। ম্যান্ডেলার দীর্ঘ কারাবাসের শেষলগ্নে তাঁহাকে ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত করিয়া তাঁহার সংগ্রামের প্রতি সংহতি জানানো হয়। তাঁহার প্রয়াণ ভারতের কাছেও বড় ক্ষতি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাহা সখেদ উল্লেখও করিয়াছেন। উত্তরোত্তর বামনাকার মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা যে তাঁহার কীর্তির মধ্য দিয়া ক্রমেই দৈত্যের অবয়ব পরিগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক জে এম কোয়েট্জি ম্যান্ডেলাকে সেই বিরল মহত্ত্বের অধিকারী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, যে-মহত্ত্বের ধারণাটিও ক্রমশ ইতিহাসের ছায়ান্ধকারে লীন হইতেছে। মহাত্মা গাঁধী সম্পর্কে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা সম্ভবত ম্যান্ডেলা সম্পর্কেও পুনরুচ্চারণ করা যায় এমন একজন মানুষ যে বাস্তবিকই এই গ্রহে একদা পদচারণা করিয়াছেন, ভবিষ্যত্ প্রজন্ম তাহা অবাক বিস্ময়ে ভাবিবে। |