|
|
|
|
শরীরে বিষ, ফতিমাদের তাই বর জোটে না |
সোমা মুখোপাধ্যায় • ভোপাল
৪ নভেম্বর |
শ্রীরামনগরের ফতিমা, মুনাব্বারি মসজিদ এলাকার জুলেখা কিংবা আরিফ নগরের বাসন্তী বা গরিব নগরের সোনি জীবনের ছবিটা এঁদের সকলেরই কমবেশি একই রঙে আঁকা। ৮৪’র ডিসেম্বরে ভোপাল গ্যাস বিপর্যয়ের সময় এঁদের অনেকের বয়স ছিল বড়জোড় দুই কী তিন। কেউ বা সদ্য জন্মেছে। কিন্তু ‘গ্যাস ভিক্টিম’ তকমাটা গায়ে সেঁটে রয়েছে তখন থেকেই। আর তাই, সে দিনের খুদে, আজকের বিবাহযোগ্যা মেয়েগুলিকে বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চায় না ভোপালের কেউ-ই।
ছেলের বাড়ির বক্তব্য, ফতিমাদের শরীরে বিষ ঢুকেছে। তাতে তাঁরা অনেকেই সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না। আর পারলেও সেই সন্তানের বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তা ছাড়া, বিষাক্ত গ্যাস এক বার যার শরীরে ঢুকেছে, তাকে তো আজীবন নানা রোগ নিয়েই কাটাতে হবে। একেই তো বেশির ভাগ পরিবারে একাধিক সদস্য অসুস্থ, তার ওপরে বাড়তি এক জনের জীবনভর চিকিৎসার দায় নেবে কে? প্রশ্ন উঠতে পারে যে, একই সমস্যা তো পুরুষদের ঘিরেও। তবে তাঁরা কেন বিয়ের বাজারে ‘ফ্যালনা’ নয়? হাত পা অসার হওয়া, শ্বাসকষ্ট, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়ার সমস্যা নিয়েও তাঁরা কী ভাবে বিয়ে করছেন?
উত্তরটা দিলেন রসিদা বিবি। তিনি ‘ভোপাল গ্যাস পীড়িত মহিলা স্টেশনারি কর্মচারী সঙ্ঘে’র নেত্রী। দুর্গতদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য নিরন্তর লড়ে যাচ্ছেন প্রৌঢ়া। বললেন, “শুধু ভোপাল কেন, এই বৈষম্য তো সর্বত্র। |
|
সরকারি তরফে যদি এই সব মেয়েদের জন্য কোনও কাজের ব্যবস্থা করা হতো, তা হলে অন্তত তাঁরা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারত। তবে পুরুষরাও দাম্পত্য জীবনে খুব একটা স্বস্তিতে নেই।” রসিদা জানালেন, এক বেসরকরি সংস্থা সম্প্রতি সমীক্ষা করে জানিয়েছে, ৮৪-র গ্যাস দুর্গত পুরুষদের অধিকাংশেরই শুক্রাণুর সংখ্যা কম। যে জন্যে অনেকেই সন্তানের জন্ম দিতে পারছেন না।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিগুলোতে ৪০%-র বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আবার নিজেদের সমস্যার কথাই অনেকে জানেন না। ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিওরের ঝুঁকি বাড়ে।
শ্রীরামনগরের ফতিমার কথায়, “সবাই মনে করে আমাদের বিয়ে করলে রোজগারের বেশিরভাগটাই চিকিৎসার খরচে বেরিয়ে যাবে। ভুলও তো কিছু ভাবে না।” এলাকার মেয়েদের ব্লাউজ সেলাই করে কোনও মতে সংসার চলে ৩২ বছরের তরুণীর। কথা বলতে বলতেই কাশির দমকে গলা বুজে এল। কোনও মতে সামলে নিয়ে বললেন, “কোনও অন্যায় না করে কিসের শাস্তি পাচ্ছি কে জানে!” জুলেখা আর সোনির প্রশ্ন, “এই জীবনের জন্য আমরা তো দায়ী নই। কেন সরকার আমাদের কাজের ব্যবস্থা করবে না?” তাঁদের এই দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন ‘ভোপাল গ্যাস পীড়িত নিরাশ্রিত পেনশন ভোগী সংঘর্ষ মোর্চা’র আহ্বায়ক বালকৃষ্ণ নামদেব। তাঁর কথায়, “শুধু তো বিয়ে নয়, জীবনধারণের জন্য কাজও জুটছে না তাঁদের। সরকার মাসে তো দেড়শো টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা দিচ্ছে।”
পটেল গলির পঞ্চাশ বছরের প্রেম বাই-এর গল্পটা সামান্য আলাদা। তাঁর স্বামী ভগবান দাস রেলে চাকরি করেন। গ্যাস লিকের রাতে তিনি ভোপালের বাইরে ছিলেন। মেয়ে ও শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেলেও বেঁচে যান প্রেম। স্বামী ভোপালে ফিরে তাঁর সঙ্গে থাকতে শুরু করেন ঠিকই, কিন্তু কোনও শারীরিক সম্পর্ক ছিল না। প্রেম বাইয়ের কথায়,“স্বামী স্পষ্টই বলেছিলেন, ওই গ্যাস আমার শরীরে ঢুকেছে। যদি আমার থেকে ওর শরীরে সংক্রমণ হয়। এর পর এক দিন আমাকে ছেড়ে চলে যান। আর ফেরেননি।” এখন এক চোখে দেখতে পান না প্রেম। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা সব সময়ের সঙ্গী। বিড়ি বেঁধে কোনও মতে দু’বেলার খাবার জোগাড় হয়।
এখনও ইউনিয়ন কার্বাইডের বর্জ্য সরানোর কোনও ব্যবস্থা হয়নি। তাই ভোপালের ভাগ্যে থেকে এই অভিশাপ এখনই মোছার নয়। গুজরাত, মুম্বইয়ে নিয়ে গিয়ে বর্জ্য পোড়ানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। রাজি হয়নি দুই রাজ্য। জার্মানির হামবুর্গের ইনসিনারেশন প্ল্যান্টে পাঠানোর ব্যবস্থা এক সময় পাকা হয়েছিল। পরে তা-ও বাতিল হয়। তাই ভবিষ্যতও অনিশ্চিত অসংখ্য মানুষের। আর প্রশাসন বলছে, “অত বড় বিপর্যয়ের ধাক্কা তো থাকবেই।”
|
পুরনো খবর: তিন দশকের লড়াইয়ে ভোপালের পাশে সথ্যু |
|
|
|
|
|