তিন দশকের লড়াইয়ে ভোপালের পাশে সথ্যু
রূপকথায় এমনটা হয়। আবার বাস্তবেও। বিষের জ্বালায় মৃতপ্রায় শহরের বুকে ফিনিক্স পাখির মতো আশা জাগিয়ে রেখেছেন এক আধা-বাঙালি। হ্যাঁ, নিজের সম্পর্কে এই বিশেষণটাই পছন্দ আদতে ওড়িয়া, কিন্তু ছত্তীসগঢ়ে যৌবনের অনেকটা সময় কাটানো সতীনাথ ষড়ঙ্গীর। চুরাশির গ্যাস লিকের ঘটনায় বিধ্বস্ত একটা শহরকে ঊনত্রিশ বছর ধরে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার নেপথ্যে প্রধান চরিত্র এই সতীনাথ ওরফে সথ্যুর। ভোপাল আন্দোলনের মুখ এবং মস্তিষ্ক দু’টোই।
বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র, মেটালার্জির ইঞ্জিনিয়ার সথ্যু দিব্যি পি এইচ ডি করছিলেন। ৩ ডিসেম্বর ১৯৮৪-র সকালে রেডিওতে শুনেছিলেন ভোপালে কীটনাশক তৈরির কারখানায় গ্যাস লিক করে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছে। সেই খবরটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ছত্তীসগঢ় থেকে সেই যে এলেন, আর ফিরলেন না।
কেন? ঝরঝরে বাংলায় ষাট বছরের তরতাজা যুবক বললেন, “যাঁরা মারা গিয়েছেন বা তিলতিল করে মারা যাচ্ছেন, তাঁরা অধিকাংশই গরিব। নিজেদের কথাই গুছিয়ে বলতে পারেন না, শুধু সব অন্যায় মেনে নিতে জানেন। দেখেশুনে মনে হল, যদি না এঁদের পাশে দাঁড়াতে পারি তা হলে লেখাপড়া শিখলাম কিসের জন্য।” ব্যস সিদ্ধান্ত হয়ে গেল।
ভোপালে গ্যাস দুর্গত মানুষের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য এখন একাধিক সংগঠন তৈরি হয়েছে। কিন্তু সবই পরবর্তী বছরগুলিতে। দুর্ঘটনার ঠিক তিন দিনের মাথায় তৈরি হয়েছিল ‘বিষাক্ত গ্যাস কাণ্ড সংঘর্ষ মোর্চা’। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংহের বাড়ির সামনে ধর্না, শীতের রাতে রাস্তায় কাঠ-পাতা জ্বালিয়ে কয়েক হাজার মানুষের অবস্থান, অনশন, রেল-রোকো এ সবেরই পুরোভাগে ছিলেন সথ্যু। মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, অসুস্থদের আর্থিক সাহায্য, যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং নিরাপদ পানীয় জলের দাবিতে শুধু ভোপাল বা দিল্লি নয়, ভুক্তভোগীদের নিয়ে আমেরিকাতেও গিয়েছেন একাধিকবার। ইউনিয়ন কার্বাইড বা পরে যাঁরা সেই কোম্পানির দায়িত্ব নেয় সেই ডাও কেমিক্যালের দফতরে।
রচনা-সথ্যু। —নিজস্ব চিত্র।
আমেরিকাবাসীদের বুঝিয়েছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কত বড় দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রদেশের এই শহরে। দাবি আদায়ের লড়াইয়ে নেমে ভারত, আমেরিকা দু’জায়গাতেই জেল খেটেছেন একাধিকবার।
বছর দেড়েক আগে হার্টের অসুখ ধরা পড়ে। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করতে হয় সথ্যুর। তবু দৌড় থামেনি। এ রকম দৌড়তে দৌড়তেই এক বার আমেরিকায় ধর্না দিতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল রচনার সঙ্গে। মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে এম বি এ পড়ার পরে এক বহুজাতিকে চাকরি করছিলেন রচনা। মানবাধিকার আন্দোলন নিয়ে তাঁর বিশেষ কোনও মাথা ব্যথা ছিল না। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই তাঁর মাথাটা ঘুরিয়ে দেন সথ্যু। সব হারানো মানুষদের নিয়ে সথ্যুর আন্দোলন তাঁকে এমনই প্রভাবিত করে যে আমেরিকার উজ্জ্বল কেরিয়ার ছেড়ে পঞ্জাবি পরিবারের এই মেয়ে চলে এসেছিলেন ভোপালে। গ্যাস দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে।
আজীবন আরও এক জনেরও পাশে দাঁড়ানোর শপথ নিয়েছেন রচনা। সথ্যুর পাশে। ষাটের সথ্যুকে বছর দু’য়েক আগে বিয়ে করেছেন সাইত্রিশের রচনা ধিংড়া।
বিষে জরজীর্ণ ভোপালে বড় হয়ে দেখা গিয়েছিল নিরাপদ পানীয় জলের দাবিও। ২০০৬ সালে সুপ্রীম কোর্ট জানিয়েছিল, শহরের ১৪টি এলাকার জল বিষাক্ত। পরে তা বেড়ে হয়েছে ২২টি এলাকা। ওই সব এলাকায় জলের নমুনা পরীক্ষা করে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টক্সিকোলজি রিসার্চ’ জানিয়েছে, ২০০৭ সালে যেখানে জলে টেট্রাক্লোরাইডের যে মাত্রা ছিল, ২০১০-এর পরে তা আরও তিন শতাংশ বেড়েছে। ‘বিশ্ব স্বাস্থা সংস্থা’র নির্দেশিকা অনুযায়ী যা স্বাভাবিকের থেকে ২৪০০ গুণ বেশি।
এই পরিস্রুত জলের দাবিতেই দু-দু’বার ভোপাল থেকে হেঁটে দিল্লি গিয়েছেন সথ্যু ও তাঁর দলবল। এক বার ২০০৬ আর তার পর ২০০৮-এ। সেই লড়াইয়ের খানিকটা ফল মিলেছে অতি সম্প্রতি। বাইশটি এলাকার বেশ কিছু অংশে এখন পুরসভার জল পৌঁছচ্ছে। সথ্যুর আক্ষেপ, “এখনও হাজার খানেক পরিবার এর আওতার বাইরে। যত দিন না তাঁরাও নিরাপদ পানীয় জল পাবেন তত দিন আমার শান্তি নেই। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।” বস্তুত এই জেদই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বরাবর। একটা লাল চেক গামছা সব সময় পাগড়ির মত জড়ানো থাকে সথ্যুর মাথায়। জানতে চেয়েছিলাম, কেন? উত্তর দিলেন তাঁর ট্রাস্টের কর্মী শেহনাজ আনসারি। বললেন, “চুরাশিতে শিখদের উপরে আক্রমণ হচ্ছিল, তখন জেদ করে মাথায় পাগড়ি পড়া শুরু করেন সথ্যু স্যার। যাতে লোকে ওঁকেও শিখ ভাবে। এটা ছিল তাঁর প্রতিবাদ।”
পশ্চিমবঙ্গে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরাও কীভাবে যেন জড়িয়ে গিয়েছেন ভোপালের সঙ্গে। কলকাতার চিকিৎসক জ্যোতির্ময় সমাজদারের কথায়, “চুরাশি থেকে বারবার ছুটে যাচ্ছি ভোপালে। দুর্গত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। আর প্রতিবারই দেখছি ওই একটা লোক ভরপুর প্রাণশক্তি নিয়ে লড়ে যাচ্ছে।”
কলকাতার সেন্ট জোসেফ স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনো করেছেন আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পাওয়া মানবাধিকার কর্মী সথ্যু। রেল চাকুরে বাবা তখন পরিবার নিয়ে থাকতেন শিয়ালদহে। স্কুলে বাংলা পড়তে পড়তে কখন যেন ভাষাটাকে ভালবেসে ফেলেন। সেই ভালবাসা অটুটু আজও। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ আওড়ান। আনমনে বলে ফেলেন, “এই একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় আমার থেকেই গিয়েছে।”
ভোপালের মানুষকেও সেই আশ্রয়ের খোঁজ দিতেই এখন জীবন পণ রেখেছেন এই আধা-বাঙালি যুবক। রূপকথায় যেমন হয় আর কি!

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.