বিষ-বস্তার কালো জলে কালরাত্রিরই স্মৃতি
তিন দশক আগের মুহূর্তটাকে ঠিক যেন কেউ স্থির করে রেখেছে! সিনেমার পরিভাষায় যাকে বলে ‘ফ্রিজ শট!’
কাঠামোটা এখনও এক রকম। মূল ফটক সিল করে দেওয়া। প্রশাসনের বিশেষ অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই নাকে এল ঝাঁঝালো কটু গন্ধ। পাঁচিল ঘেরা চত্বরের ভিতরে এখনও যে ঠাসা বস্তা বস্তা রাসায়নিক! কীটনাশক! তার উপাদান আদতে কী, না জানলেও বস্তার গায়ে ইংরেজিতে লেখা ‘পয়জন’ শব্দটাই আগন্তুকের হাড় হিম করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
ভিন রাজ্যের সাংবাদিক শুধু নয়। বস্তুত ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইডের পরিত্যক্ত কারখানার চৌহদ্দিতে পা রাখলে যে কারও মালুম হতে বাধ্য, মারণ ধোঁয়া মিলিয়ে গেলেও তার আতঙ্কের বিষ কী ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে গোটা শহরটার পরতে পরতে। তিন-তিনটে দশকের সময়স্রোতও তা মুছে ফেলতে পারেনি। আর মূর্তিমান সেই ত্রাসেরই প্রতীক যেন ডাঁই করে রাখা বস্তাগুলো, যাতে মজুত রাসায়নিকের বিষক্রিয়া যখন-তখন মারাত্মক চেহারা নিতে পারে বলে সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট।’
ইউনিয়ন কার্বাইডের পরিত্যক্ত কারখানা।
হুঁশিয়ারিতে আতঙ্ক বেড়েছে বই কমেনি। কারণ, ত্রাসের উৎস রয়েছে যেমন-কে-তেমন। তার উপরে বর্ষার সময়ে ভাঙাচোরা দরজা-জানলা গলে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টির জল ঢোকে। ভেজা বস্তা থেকে চুঁইয়ে বাইরে গড়িয়ে আসে কালো জল, তীব্র গন্ধ সমেত। উস্কে ওঠে দুঃসহ স্মৃতি। ভয়ে দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়। দূরে, বহু দূরে পালাতে চান আশপাশের মানুষ। কিন্তু যাবেন কোথায়? কত দূরে?
আতঙ্ক থিতিয়ে গেলে তাই ফিরতে হয় পুরনো ডেরায়। ফের বিপর্যয়ের প্রহর গুনতে গুনতে কাটাতে হয় আরও একটা দিন।
মারণ অভিজ্ঞতার বোঝা এই ভাবে প্রতি মহূর্তে টেনে চলেছেন ভোপালবাসী। ভোপাল গ্যাস-কাণ্ড আজ তিরিশ বছরে পা দিল। ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর মাঝরাত থেকে ৩ ডিসেম্বর ভোরের মধ্যে মৃত্যুনগরীর চেহারা নিয়েছিল তৎকালীন অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশের রাজধানী শহরটি। ইউনিয়ন কার্বাইডের কীটনাশক কারখানা থেকে মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস লিক করে ক’দফায় প্রাণ হারিয়েছিলেন পঁচিশ হাজারের বেশি মানুষ। ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক। মৃত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি তরফে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ভুক্তভোগীদের সংগঠনগুলির অভিযোগ, দুর্গতদের অতি নগণ্য অংশই সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। পাশাপাশি অভিযুক্তেরা কেউ সাজা পায়নি।
অর্থ বা বিচার তিরিশ বছরে কোনওটাই সে ভাবে না-মেলায় দুর্গতেরা ফুঁসছেন। পরিত্যক্ত কারখানা চত্বরে বিষ-বস্তার স্তূপের মতো নিত্যনতুন বিপদ-সঙ্কেত ক্ষোভের আগুনে ইন্ধন দিচ্ছে। আর এ সবের মধ্যেই তিন দশক আগের এক কালান্তক রাতের মাসুল গুনে চলেছে নতুন প্রজন্ম। কী রকম?
সুুপ্রিম কোর্ট ভোপালের বাইশটি অঞ্চলকে গ্যাস-দুর্গত হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। পরে একাধিক বেসরকারি সংস্থা সেখানে সমীক্ষা চালিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক ও মধ্যপ্রদেশ স্বাস্থ্য দফতরে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই সব তল্লাটে জন্ম নেওয়া শিশুদের অন্তত দশ ভাগ বিবিধ জন্মগত বিকৃতির শিকার। কারও আঙুল নেই, কারও কাটা ঠোঁট, কারও একটা বা দু’টো পা-ই ছোট। কেউ আবার চলচ্ছক্তিহীন। বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, এঁদের অধিকাংশ জিনগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাচ্ছে, যার পিছনে রয়েছে পূবর্বতী প্রজন্মের রক্তে মেশা মারণ রাসায়নিকের প্রভাব। দিন কয়েক আগে কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র ভোপাল ঘুরে গিয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “ক্রোমোজোম ভেঙে যাচ্ছে। পরিণতিতে শিশুরা জন্মাচ্ছে নানা অস্বাভাবিকতা নিয়ে।”
অস্বাভাবিকতার বহর যে কতখানি, ভোপালের সরকারি চিকিৎসকদের বড় অংশের বয়ানে তার নমুনা। ওঁরা জানিয়েছেন, এখন মায়ের দুধের সঙ্গেও শিশুর শরীরে ঢুকছে ক্লোরোফর্ম। ঢুকছে নিকেল-পারদ-সিসার মত ভারী ধাতু। বিষ-গ্যাস কবলিত এলাকার মানুষ যে শাকশব্জি খাচ্ছেন, যে জল পান করছেন, তার মারফত ওঁদের শরীরে এখনও প্রবেশ করছে বিষ। পরিণামে শ্বাসকষ্ট, হরেক চর্মরোগ, নানা অঙ্গে অসাড়তা। মহিলাদের ঋতুচক্রের সমস্যার সঙ্গে ক্যানসার, যক্ষ্মার দাপট বাড়ছে। প্রায় তিরিশ বছর আগের গ্যাস লিকজনিত অসুস্থতার জেরে এখনও ফি মাসে ৭-১০ জন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
কারখানার উত্তর প্রান্তের বস্তিতে গেলে বোঝা যায়, বিষের স্রোত কী ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
আতঙ্কের উৎস। কারখানা চত্বরে এখনও পড়ে রয়েছে বিষ-রাসায়নিকের বস্তার স্তূপ।
ওই রাজগড় কলোনিতে গত তিন দশকে বিকলাঙ্গের সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে। ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ওখানে তিনটে ‘সোলার ইভাপোরেশন পন্ড’ তৈরি হয়েছিল। দুর্ঘটনার পরে তিন পুকুরের বর্জ্য একটায় জড়ো করে মাটি চাপা দিয়ে উপরে প্লাস্টিক বিছিয়ে সিল করা হয়। গত দু’-তিন বছর ইস্তক প্লাস্টিকের চাদর ভেদ করে কালো জল বাইরে বেরিয়ে আসছে। “সেটাই হয়তো মিশছে আমাদের শরীরে।” তিন বছরের পঙ্গু নাতিকে স্নান করাতে করাতে বললেন যমুনা বিবি।
ভোপাল-বিপর্যয়ের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে এই প্রৌঢ়াকে খাড়া করা যায়। চুরাশির ওই রাতে স্বামী-মেয়েকে হারিয়ে ছেলেকে নিয়ে কোনও মতে প্রাণে বেঁচেছিলেন। তবে সুস্থ থাকতে পারেননি। তিরিশ বছর ধরে ঘন ঘন জ্বর হয়, অল্পে হাঁফ ধরে। ছেলেরও ফুসফুসের রোগ। নাতির মুখ দেখার আনন্দ ফিকে হয়ে যায় যখন শোনেন, বাচ্চাটির চলাফেরার শক্তি নেই। জয়প্রকাশ নগরে গিয়ে জানা গেল, বাচ্চারা কেউ টানা পঞ্চাশ মিটার দৌড়োতে পারে না। ধুঁকতে থাকে। তাদের মা-বাবাদের নিত্যসঙ্গী মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, শ্বাসকষ্ট। দিরুমন কলোনির শাহজাদি বিবি সে রাতে প্রাণে বাঁচতে সপরিবার একটা ট্রাকে চড়েছিলেন। শরীর জুড়ে তখন অসহ্য জ্বালা, দৃষ্টি ঝাপসা। শহর ছাড়িয়ে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ট্রাক থেকে নামলেও এক বছরের মেয়েটার কথা খেয়াল ছিল না। মাঝবয়সী বধূর মনে সেই ক্ষত দগদগে।
শোক-আক্ষেপ-যন্ত্রণা-হাহাকার। ভোপালের আনাচে-কানাচে তারই ছবি। ব্লু মুন কলোনি, চাঁদবাড়ি, নবাব কলোনি, আরিফনগর, সুন্দরনগর সর্বত্র। উপরন্তু বহু জায়গায় ইদানীং বাচ্চাদের জন্মের পরেই চামড়ায় নানা ধরনের ঘা হচ্ছে বলে জানালেন স্থানীয় ডাক্তার মৃত্যুঞ্জয় মালি। চর্মরোগ চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা: পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের তিরিশ-চল্লিশ বছর বাদেও নাগাসাকিতে ‘আয়োনাইজিং এফেক্ট’ ছিল। ভোপালেও অতীত বিপর্যয়ের রেশ থেকে গিয়েছে। এ সব তারই ফলশ্রুতি।
রাজ্য প্রশাসনের কী ভূমিকা?
মধ্যপ্রদেশের ত্রাণ ও গ্যাস রিলিফ মন্ত্রী বাবুলাল গৌড় অবশ্য দুর্দশা প্রসঙ্গ আলোচনার চেয়ে সরকারের সাফল্য বর্ণনায় বেশি উৎসাহী। “ক্ষতি তো হয়েইছে। কিন্তু সরকার যে ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পথ দেখাচ্ছে, সেটাই আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে।” বলছেন তিনি।
যদিও মন্ত্রীর দাবিতে বঞ্চনার জ্বালা জুড়োচ্ছে না। গ্যাস-দুর্গতদের কয়েকটি সংগঠন আজ সন্ধ্যায় শহরে মোমবাতি-মিছিলের আয়োজন করেছিল। ইকবাল ময়দানে শুরু হয়ে বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে মিছিল শেষ হল ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার সামনে। প্রতিবাদীরা আরও এক বার নীরবে চেয়ে দেখলেন তাঁদের দুর্ভাগ্যের উৎসকেন্দ্রকে। ঊনত্রিশ বছর আগের এক কালরাত্রিকে স্মরণ করে আরও এক বার শিউরে উঠলেন অনেকে।
এবং ওঁরা সকলে মিলে আরও এক বার শপথ নিলেন, সুবিচারলাভের লড়াই থেকে সরবেন না কোনও মতে।

—নিজস্ব চিত্র।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.