এসজেডিএ-র দুর্নীতির ঘটনায় সিবিআই তদন্ত চেয়ে সরব হয়েছে বিরোধীরা। রাজ্য সরকার দুর্নীতিকে আড়াল করতে চাইছে বলেও তাদের অভিযোগ। এমন পরিস্থিতিতে এ বার বিরোধীদের পাল্টা নিশানা করা শুরু হল শাসক দল তৃণমূলের তরফে।
এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব নিশানা করেছেন অশোক ভট্টাচার্যকেই। জেলাশাসক গ্রেফতার এবং তার জেরে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার অপসারণের পরে সিবিআই তদন্ত চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা প্রথম বলেছিলেন অশোকবাবুই। বাম জমানার মন্ত্রী অশোকবাবুকেই এ বার ঘটনাপ্রবাহে জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন গৌতমবাবু। তাঁর কথায়, “কুড়ি বছর ধরে অশোক ভট্টাচার্য এই সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন। এসজেডিএ-র পরিকাঠামোতে যে চাকরি হয়েছে, তার বেশির ভাগই রাজনৈতিক নিয়োগ। এসজেডিএ-র দুর্নীতির মামলায় যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের একাংশ সিপিএমের। সেখানে বাস্তুকার থেকে ঠিকাদার রয়েছে।” মন্ত্রীর অভিযোগ, এঁদের কারও পরিবার সিপিএম-সমর্থক, কেউ আবার সিপিএমের শাখা সংগঠনের নেতা ছিলেন। অশোকবাবুর আমলেই তাঁরা চাকরি পেয়েছেন। এর থেকেই বোঝা যায়, বাম আমলে কী হয়েছে!
অশোকবাবু অবশ্য গৌতমবাবুর বক্তব্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাননি। মন্ত্রী অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ এনেছেন। মন্ত্রীর কথায়, “চেয়ারম্যান থাকার সময়ে নিজের ক্ষমতাবলে তিনি বহু লোককে জমি দিয়েছেন। উত্তরায়ণের ৬০০ একরের জমি কত দামে কী ভাবে দেওয়া হয়েছে, তা দেখা হচ্ছে। আমাদের মনে হচ্ছে, ১৫০ কোটি টাকা সরকারি লোকসান হয়েছে। একটি সংস্থাকে দিয়ে সব তদন্ত করানো হচ্ছে।” মন্ত্রীর আরও বক্তব্য, অশোকবাবুদের আমলে শিলিগুড়ি শহরে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিছু ক্ষেত্রে এখন কাগজপত্রই পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের পুলিশ ক্লিন চিট দিয়েছে। প্রয়োজনে নতুন করে আবার মামলাগুলি দেখা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন গৌতমবাবু।
জমি, চাকরির নিয়োগ এবং বিভিন্ন খুনের মামলার প্রশ্নে মঙ্গলবার অশোকবাবুর পাল্টা বক্তব্য, বাম আমলে এসজেডিএ-র সিএজি অডিট হয়েছে। কখনও কোনও দুর্নীতির বিষয় সামনে আসেনি। তাঁর কথায়, “চাকরি তো বাম আমলে লক্ষ লক্ষ লোক পেয়েছেন। সবই কি দুর্নীতি? আর খুনের একাধিক মামলা, জমি বিলি এ সব অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি! আমাদের কাছে মন্ত্রীর কথার কোনও গুরুত্ব নেই!” অশোকবাবুর আরও কটাক্ষ, “যা হল, সবই তো তৃণমূলের আমলে! তাই মন্ত্রী যত কম মন্তব্য করবেন, ততই ভাল। নইলে হয়তো অনেক কিছু বার হয়ে আসবে!”
এসজেডিএ-কাণ্ডে প্রতিবাদের সুর মিলে গিয়েছে বাম ও কংগ্রেসের। গৌতমবাবুও পাল্টা দু’পক্ষের আঁতাঁতের কথা বলেছেন। তাঁর মন্তব্য, “দুর্নীতির মামলায় নানা কথা, সিবিআই তদন্তের কথা বলা হচ্ছে। দার্জিলিং জেলা কংগ্রেসের সভাপতিকেও তো পুলিশ জেরা করেছে! বামেরা শুধু তৃণমূলের কথা বলছে, কংগ্রেসের নাম সামনে আনছে না। এর থেকেই দুই দলের আঁতাঁত পরিষ্কার!”
গৌতমবাবুর ইঙ্গিত যাঁর দিকে, দার্জিলিং জেলা কংগ্রেসের সেই সভাপতি তথা মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক শঙ্কর মালাকারের বক্তব্য, “এসজেডিএ-র ১১ জন বোর্ড সদস্যের মধ্যে আমিই এক মাত্র কংগ্রেসের। ৭ জন তৃণমূলের। তাই এক জন বোর্ড সদস্য সংস্থার সিদ্ধান্তে কী ভূমিকা পালন করতে পারেন, তা বোঝাই যায়! আর জেরা করা হলে যদি কেউ দোষী হন, তা হলে মন্ত্রী আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন!” কংগ্রেসেরও একাংশের অভিযোগ, দুর্নীতির অভিযোগে নাম জড়ানোর পরে শঙ্করবাবুর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে তাঁকে কিছুটা আড়াল করার চেষ্টা করছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। পদ থেকে শঙ্করবাবুকে ইস্তফা দেওয়ার কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, “শঙ্করের সরা বা না-সরার ব্যাপারে এখনও কোনও আলোচনাই হয়নি। কী ঘটেছে, বিশদে জানতে হবে।”
পুলিশ যাঁদের জেরা করেছে, তাঁদের অধিকাংশই তৃণমূলের নেতা-কর্মী। এই তথ্য মন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিয়ে শঙ্করবাবুর দাবি, পুলিশ কমিশনার কে জয়রামনকে অপসারণের পরে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের উপরে আর ভরসা করা যায় না। প্রদেশ সভাপতি জানিয়েছেন, সিবিআই তদন্তের দাবিতে শঙ্করবাবুর নেতৃত্বেই কংগ্রেস বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে আইন অমান্য করবে।
সরকারের ভূমিকায় সঠিক তদন্তের আশা একেবারেই নেই বলে যুক্তি দিয়ে সিবিআই তদন্তের দাবি তোলা অব্যাহত রেখেছেন অশোকবাবুরাও। সরাসরি সিবিআইয়ের কথা না-বললেও বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এ দিন অভিযোগ করেছেন, দুর্নীতি মামলায় তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের নাম জড়িয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কাতেই তদন্তকারী অফিসার জয়রামনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিমানবাবুর কথায়, “দুর্নীতির তদন্তের মাঝ পথে অতীতে কোনও তদন্তকারী আইপিএস অফিসারকে এ ভাবে সরানো হয়নি। রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষের সময় থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সময় পর্যন্ত কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি!”
|