গোদালা কিরণ কুমারকে গ্রেফতারের পরে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারকে সরানোর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামা সিপিএম ও কংগ্রেসের একাংশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুললেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। মঙ্গলবার গৌতমবাবু সিপিএম ও কংগ্রেসের নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ সামনে রেখে পথে নামার হুমকিও দিয়েছেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর অভিযোগের তির মূলত গিয়েছে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য ও দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস (সমতল) সভাপতি শঙ্কর মালাকারের দিকে। গৌতমবাবুর অভিযোগ, “দু-দশক এসজেডিএ-এর চেয়ারম্যান থাকার সময়ে যথেচ্ছ নিয়োগ করেছিলেন অশোকবাবু। এসজেডিএ-এর দুর্নীতি মামলায় যে কজন ইঞ্জিনিয়র গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁরা সকলেই অশোকবাবুর আমলে নিযুক্ত। কী ভাবে নিযুক্ত হয়েছেন, কার কতটা যোগ্যতা ছিল তা নিয়ে অনেক কিছু শুনছি। বাম আমলে নিযুক্তদের একাংশকে কাজে লাগিয়ে এসজেডিএ-এর কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করছেন অশোকবাবু।” |
সাংবাদিক সম্মেলনে গৌতম দেব। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
সেই সঙ্গে সম্প্রতি অশোকবাবু এসজেডিএর অভ্যন্তরীণ তদন্ত রিপোর্টের প্রতিলিপি সংবাদ মাধ্যমের সামনে তুলে ধরায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গৌতমবাবু। তিনি বলেন, “ওই রিপোর্ট বোর্ড মিটিঙে পেশের পরে জনসমক্ষে আনা হয়। তার আগেই বাইরে চলে গেল কী করে? এটা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। যে বা যাঁরা তথ্য পাচারে যুক্ত বলে প্রমাণ হবে, প্রয়োজনে তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হবে।”
গত সোমবার প্রাক্তন পুরমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে এসজেডিএ দুর্নীতি মামলার সিবিআই তদন্তের দাবি সেখানে তিনি এসজেডিএ-র তরফে নিযুক্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তদন্ত কমিটির রিপোর্টের একাংশ সংবাদ মাধ্যমকে দেখান। তা নিয়েই ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা এসজেডিএ-এর বর্তমান চেয়ারম্যান।
এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “২০ বছর ধরে অশোক ভট্টাচার্য এই সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন। এসজেডিএ-র পরিকাঠামোতে যে চাকরি হয়েছে, তার বেশিরভাগই রাজনৈতিক নিয়োগ। বর্তমানে এসজেডিএ-র দুর্নীতির মামলায় যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের একটি অংশ সিপিএমের লোক। সেখানে বাস্তুকার থেকে ঠিকদার রয়েছে। এদের কারও পরিবার সিপিএমের লোক, কেউ আবার সিপিএমের শাখা সংগঠনের নেতা ছিলেন। অশোকবাবুর আমলেই তাঁরা চাকরি পেয়েছেন। এর থেকেই বোঝা বাম আমলে কী হয়েছে।”
অশোকবাবুর বিরুদ্ধে তাঁর গৌতমবাবুর আরও অভিযোগ, “চেয়ারম্যান থাকার সময় নিজের ক্ষমতাবলে তিনি বহু লোককে জমি দিয়েছেন। উত্তররায়ন, হিমাঞ্চল বিহার এর মধ্যে রয়েছে। উত্তরায়নের ৬০০ একরের জমি কত দামে কীভাবে দেওয়া হয়েছে তা দেখা হচ্ছে। আমাদের মনে হচ্ছে ১৫০ কোটি টাকা সরকারি লোকসান রয়েছে। একটি সংস্থাকে দিয়ে সব তদন্ত করানো হচ্ছে।”
একই সঙ্গে বাম আমলে শিলিগুড়ি শহরে শিবু চৌহান, দিবাকর মণ্ডল, উদয় চক্রবর্তী এবং সোনু পটেলের খুনের ঘটনার পুনর্তদন্তের দাবি তুলেছেন গৌতমবাবু। তিনি বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে আমরা কাগজপত্রই পাচ্ছি না। কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের পুলিশ ক্লিনচিট দিয়েছে। আমরা সব মামলা আবার খতিয়ে দেখছি। প্রয়োজনে নতুন করে মামলাগুলি দেখা হবে। খুন, সংঘর্ষ আর মিথ্যাচারের রাজনীতি শিলিগুড়িতে বরদাস্ত করা হবে না। সিপিএম এবং কংগ্রেসের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে। যাঁরা ওইসব দল ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন, তাদের সামাজিক বয়কটের কথা বলা হচ্ছে। খুব দ্রুত রাজনৈতিকভাবে রাস্তায় নেমে আমরা এ সবের বিরুদ্ধে প্রচার করা হবে বলেও গৌতমবাবু জানিয়েছেন। এর পরে গৌতমবাবু বলেন, “দুর্নীতির মামলায় নানা কথা, সিবিআই তদন্তের কথা বলা হচ্ছে। দার্জিলিং জেলা কংগ্রেসের সভাপতিকেও তো পুলিশ জেরা করেছে। বামেরা শুধু তৃণমূলের কথা বলছে, কংগ্রেসের নাম সামনে আসছে না। এর থেকেই দু’দলের আঁতাত পরিষ্কার।” |
শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) উন্নয়ন প্রকল্পে এ ভাবেই সরু তার
পেঁচিয়ে দায়সারা ভাবে শহরের রাস্তায় সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ।
শিলিগুড়ির হাসমি চকে এখনও এই অবস্থাতেই রয়েছে ক্যামেরা। —নিজস্ব চিত্র। |
এই প্রসঙ্গে প্রাক্তন এসজেডিএ চেয়ারম্যান তথা সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা তো বলছি, এসজেডিএ মামলায় উনি এবং মুখ্যমন্ত্রীই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এর পরে পুলিশে অভিযোগ করা হয়েছে। তার পরেও তো সংস্থার তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিককে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে একজনকে ধরা হলেও তৃণমূল বিধায়ককে কেন ধরা হচ্ছে না বোঝা যাচ্ছে না। উল্টে মুখ্য সচিবকে দেখছি, পুলিশের ভূমিকার নিন্দা করছেন। এ ভাবে তো সঠিক তদন্ত হতে পারে না। তাই আমরা সিবিআই তদন্তের দাবিতে সরব হয়েছি।”
জমি, চাকরির নিয়োগ এবং বিভিন্ন খুনের মামলার প্রসঙ্গে অশোকবাবু জানান, আমাদের সময় এসজেডিএ-র সিএজি অডিট হয়েছে। কখনও কোনও দুর্নীতির বিষয় সামনে আসেনি। যা হল সবই তো তৃণমূলের আমলে। তাই মন্ত্রী যত কম মন্তব্য করবেন ততই ভাল। নইলে হয়ত অনেক কিছু বার হয়ে আসবে। আর চাকরি তো বাম আমলে লক্ষ লক্ষ লোক পেয়েছেন। সবই কী দুর্নীতি? আর খুনের একাধিক মামলা, জমি বিলি এসব অনেকদিন ধরেই শুনছি। তদন্ত করে দেখুন না!”
এই ব্যাপারে দার্জিলিং জেলা কংগ্রেসের সভাপতি তথা মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক শঙ্কর মালাকার বলেন, “এসজেডিএ-র ১১ জন বোর্ড সদস্যের মধ্যে আমিই একমাত্র কংগ্রেসের। ৭ জন তৃণমূলের। তাই একজন বোর্ড সদস্য সংস্থার সিদ্ধান্তে কী ভূমিকা পালন করতে পারে তা বোঝাই যায়। আর জেলা করা হলে যদি কেউ দোষী হন তা হলে মন্ত্রী আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। আর আমি শুধু কেন, যাঁদের পুলিশ জেরা করেছে তাঁদের অধিকাংশই তৃণমূলের নেতা কর্মী। মন্ত্রীর এ দিকটাও দেখা দরকার।” শঙ্করবাবু জানান, পুলিশ কমিশনার হিসাবে কারলিয়াপ্পন জয়রামন সঠিকভাবে তদন্ত করছিলেন। তিনি তাঁকে সাহায্যও করেছিলেন বলে দাবি করেন শঙ্করবাবু। তাঁর বক্তব্য, “যে ভাবে পুলিশ কমিশনারকে অপসারণ করা হল তাতে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের উপর ভরসা রাখা যাচ্ছে না। তাই আমরা চাই গোটা মামলার তদন্তভার সিবিআই-র হাতে তুলে দেওয়া হোক।” |