সপ্তাহের প্রথম দিন প্রত্যেক মেডিক্যাল কলেজেই রোগীর ভিড় অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি থাকে। তার মধ্যেই এক মহিলা ইন্টার্নের শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলে নিরাপত্তার দাবিতে ইন্টার্নদের কর্মবিরতি! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। কারণ, হাসপাতালের দেড়শো জন ইন্টার্নের উপরে ইমার্জেন্সি থেকে শুরু করে ওয়ার্ডের পরিষেবা অনেকটাই নির্ভরশীল। বাদ-বিবাদ, আলোচনা-বিক্ষোভে সেই কর্মবিরতি চলল টানা সাত ঘণ্টা। সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটার এই সময়েই হাসপাতালে কাজের চাপ থাকে মারাত্মক। ফলে প্রায় গোটা দিন চিকিৎসা পরিষেবা চলল খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে। ইমার্জেন্সিতে সামান্য ফার্স্ট-এড, স্যালাইন বা অক্সিজেন পেতেও বেগ যথেষ্ট পেতে হল রোগীদের। ওয়ার্ডে পাওয়া গেল না রোগীদের ওষুধপত্রের চার্ট পরীক্ষা করা, সময়মতো ওষুধ, ইঞ্জেকশন বা স্যালাইন দেওয়ার কোনও লোক।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্নদের ধর্মঘট বা কর্মবিরতি এই প্রথম নয়। হাসপাতালে কেন যথেষ্ট সংখ্যায় পুলিশ পাহারায় থাকবে না এবং কেন রোগীর সঙ্গে দল বেঁধে বাড়ির লোক ইমার্জেন্সি বা ওয়ার্ডে ঢুকে পড়বে, এই সব প্রশ্ন তুলে তাঁরা আগেও কাজ বন্ধ করেছেন। তা নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, জুনিয়র বা সিনিয়ার চিকিৎসকদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে, কিন্তু তা নিয়ে কর্মবিরতি বা ধর্মঘট বরদাস্ত করা হবে না। তা সত্ত্বেও সোমবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে কর্মবিরতি ঘোষণা করে ব্যানার-প্ল্যার্কাড নিয়ে হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ অবস্থানে বসে পড়েন ইন্টার্নরা। |
তাঁদের অভিযোগ ছিল, গত শনিবার দুপুরে এক রোগীর বাড়ির চার-পাঁচ জন লোক জবরদস্তি ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েন। তাঁরা মত্ত অবস্থায় ছিলেন। ওয়ার্ডে কর্তব্যরত মহিলা ইন্টার্নের প্রতি কটূক্তি করেন এবং তাঁর শ্লীলতাহানি করেন বলে অভিযোগ। ওই ইন্টার্ন কোনও মতে নিজের মোবাইল থেকে সহকর্মীদের ফোন করে ডাকেন। তাঁরা সেখানে পৌঁছলে রক্ষা পান ওই ইন্টার্ন।
এ দিন বিক্ষোভকারী ইন্টার্নদের প্ল্যাকার্ডেও শ্লীলতাহানির কথা লেখা ছিল। কিন্তু শনিবার ঘটনা ঘটলে সে দিন কেন তাঁরা পুলিশ বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাননি, সেই প্রশ্ন ওঠে। তাঁর জবাবে সোমবার এক ইন্টার্ন বলেন, “শনি-রবিবার হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কারও দেখা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া, একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে অভিযোগ করে কোনও ফল হবে না। এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালের ফাঁড়িতে কোনও পুলিশ থাকে না। আমরা কাজ করতে ভয় পাচ্ছি। যে কোনও মুহূর্তে আমাদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। কোনও নিরাপত্তা নেই। এর বিহিত চাইতেই আমাদের এই কর্মবিরতি।”
আচমকা শুরু হওয়া এই কর্মবিরতির খবর পেয়েই ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তেজিত ভাবে বলতে থাকেন, “এই সব অনেক দেখেছি। মামার বাড়ি নাকি যে, কথায়-কথায় কর্মবিরতি করবে! যদি নিরাপত্তা বা অন্য কিছু নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকে, তা হলে কাজ করতে-করতেই তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। কোনও ধর্মঘট-কর্মবিরতি চলবে না। আমি সুপারকে নির্দেশ দিয়েছি, কর্মবিরতি তোলা না হলে আন্দোলনরত প্রত্যেক ইন্টার্নের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হবে।” প্রসঙ্গত, ইন্টার্নরা আপাতত এক বছরের প্রশিক্ষণ-পর্বে রয়েছেন। এটা শেষ হলেই তাঁদের চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তার এই কড়া বার্তার পরেও ইন্টার্নদের অবস্থান থেকে টলানো যায়নি। তাঁরা দাবি করতে থাকেন, সুপারকে নীচে নেমে এসে তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। এ দিকে, ব্যাহত হতে থাকে রোগী পরিষেবা। ইমার্জেন্সিতে রোগী সামলাতে হিমশিম খেতে থাকেন দু’জন মেডিক্যাল অফিসার ও তিন জন নার্স। হাসপাতাল সূত্রের খবর, অন্য দিন ইমার্জেন্সিতে সকালে তিন জন ইন্টার্ন, সন্ধ্যায় পাঁচ জন এবং রাতে ছ’জন ইন্টার্ন ডিউটিতে থাকেন। বিকেল পর্যন্ত তাঁদের কেউ না থাকায় রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়াই মুশকিল হয়ে যায়।
একই রকম সমস্যা তৈরি হয় ওয়ার্ডে। সার্জারি ওয়ার্ডে ঢুকে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকালে ইন্টার্নরা শয্যায়-শয্যায় ঘুরে খবর নেন রোগীদের কী ধরনের শারীরিক সমস্যা হচ্ছে এবং তার রেকর্ড রাখেন। এ দিন সে সব কিছুই হয়নি। মেডিসিন বা গাইনি বিভাগে অনেক রোগীই শারীরিক অসুবিধার কথা জানিয়ে ডাক্তারের দেখা পাননি। রক্তচাপ মাপা, রক্ত নেওয়া, এক্স-রে বা আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মতো পরীক্ষাগুলি চালাতেও ইন্টার্নের অভাবে সমস্যায় পড়েছে চিকিৎসকেরা। সুপার পার্থপ্রতিম প্রধানের কথায়, “আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, হাসপাতালের পরিষেবাকে ধাক্কা দিতে পরিকল্পনা মাফিক ইন্টার্নদের মগজধোলাই করে কর্মবিরতির পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এটা করেছেন হাসপাতালেরই এক শ্রেণির কর্মচারী, যাঁদের বিরুদ্ধে হালে দুর্নীতির জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” তাঁর আরও বক্তব্য ছিল, “হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে প্রায় ৬০ জন পুলিশ রয়েছেন। ইন্টার্নরা যদি মনে করেন যে, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে এক জন পুলিশ দেওয়া থাকবে, তা হলে সেটা অবাস্তব ব্যাপার!”
দুপুরের পর থেকেই অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার লীনা দত্ত ও অভিষেক দে দফায় দফায় আন্দোলনরত ইন্টার্নদের কাছে গিয়ে আলোচনায় বসার জন্য আবেদন জানান। কিন্তু ইন্টার্নরা গোঁ ধরে থাকেন, তাঁরা সুপারের কাছে যাবেন না। সুপারকে তাঁদের কাছে আসতে হবে এবং সকলের সামনে আলোচনা করতে হবে। শেষে কার্যনির্বাহী অধ্যক্ষ দেবব্রত রায় ইন্টার্নদের বুঝিয়ে সুপারের কাছে নিয়ে যান। সেখানে দীর্ঘ বৈঠক হয় এবং সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ইন্টার্নরা কর্মবিরতি তুলে নেন। হাসপাতাল জানায়, ইন্টার্নদের দেওয়া স্মারকলিপিতে ‘শ্লীলতাহানি’র প্রসঙ্গই নেই। শুধু অভব্য আচরণের কথা আছে। এই বিষয়ে ইন্টার্নদের জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁরা কিছু বলতে রাজি হননি। তবে জানিয়েছেন, হাসপাতালের পরিষেবা ব্যাহত করার কোনও উদ্দেশ্য না থাকলেও ভবিষ্যতে তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তাঁরা আবার প্রতিবাদের পথ নেবেন।
এ দিকে, সোমবার রাতে হালিমা বেগম (৪৫) নামে এক রোগিণীর মৃত্যুর পরেও চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে উত্তেজনা ছড়ায় ওই হাসপাতাল চত্বরে। |