দেশের আয় কী ভাবে বাড়ানো যায়? এই প্রশ্ন হইতেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জন্ম। তাহার প্রায় দেড়শো বছর পরে, গত শতকের ত্রিশের দশকে মহামন্দায় বিপর্যস্ত পশ্চিম দুনিয়া ভাবিতে বসিল, আয়বৃদ্ধির যথেষ্ট গতি বজায় রাখা যায় কী ভাবে? এই জিজ্ঞাসা হইতে অর্থশাস্ত্রের যে ধারা প্রবাহিত হইয়াছিল, তাহার নাম ‘গ্রোথ ইকনমিক্স’। আদিপর্বে তাহার উপর যে অর্থনীতিবিদের ধারণার বিশেষ প্রভাব ছিল, তাঁহার নাম জন মেনার্ড কেইনস। তাঁহার ভাবনার সূত্র ধরিয়া রয় হ্যারড এবং এভসি ডোমার নামক দুই তরুণ অর্থনীতিবিদ স্বতন্ত্র ভাবে আয়বৃদ্ধির তত্ত্ববিচারে ব্রতী হন এবং একই গোত্রের সিদ্ধান্তে পৌঁছন। চল্লিশের দশকে তাঁহাদের তত্ত্ব অর্থশাস্ত্রের ভুবনে হ্যারড-ডোমার মডেল নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। আয়বৃদ্ধির তত্ত্ব তাহার পরে বহু দূর অবধি অগ্রসর হইয়াছে, কিন্তু সেই মডেলের মূল ধারণাটি এখনও বহুলব্যবহৃত। ধারণাটি ইহাই যে, আয়বৃদ্ধির হার নির্ভর করে দুইটি বিষয়ের উপর। এক, আয়ের কত অংশ বিনিয়োগ করা হইতেছে। দুই, বিনিয়োগ হইতে কতটা বাড়তি আয় পাওয়া যাইতেছে, অর্থাৎ বিনিয়োগ কতটা উৎপাদনশীল। ইহারা ভাল থাকিলে জাতীয় আয় দ্রুতগামী হয়, নহিলে গতিভঙ্গ।
ভারত গতিভঙ্গের শিকার। বেশ কিছু কাল আট শতাংশ বার্ষিক আয়বৃদ্ধিতে অভ্যস্ত দেশটি আপাতত পাঁচের নীচে চলিতেছে। বর্তমান অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক পর্বে (জুলাই হইতে সেপ্টেম্বর) ৪.৮ শতাংশ আয়বৃদ্ধির হিসাব মিলিয়াছে, তাহাতেই সরকারি কর্তারা যেন হাতে চাঁদ পাইয়াছেন, কারণ অনুমান করা হইতেছিল এই পর্বে বৃদ্ধির হার সাড়ে চারের নীচে থাকিবে। অদূর ভবিষ্যতে গতিবৃদ্ধির ভরসা নাই। কেন? বিনিয়োগের হার কি কমিয়াছে? চড়া সুদের হার, সংস্কারের অভাব, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসনিক অচলতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বিনিয়োগের বাজারে উৎসাহের ঘাটতি আছে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও জি ডি পি’র সাপেক্ষে বিনিয়োগের অনুপাত গত এক দশকে বিশেষ কমে নাই। গত দুই বছরে যাহা অনেকখানি কমিয়াছে, তাহার নাম বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা। অর্থাৎ, বিনিয়োগ হইতেছে, তাহা হইতে যথেষ্ট উৎপাদন হইতেছে না, ফলে আয় যথেষ্ট বাড়িতেছে না।
কেন? বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা কম হওয়ার বিবিধ কারণ আছে। একটি বড় কারণ: খনিজ সংকট। আক্ষরিক অর্থেই সেই সংকট খনি হইতে জাত। প্রধান সমস্যা কয়লা খনি লইয়া। কয়লা খনির অধিকার বণ্টনের প্রক্রিয়া দুর্নীতির অভিযোগে পর্যুদস্ত, বছরের পর বছর কার্যত স্তব্ধ, বিভিন্ন শিল্পসংস্থা জ্বালানির অভাবে ভুগিতেছে। সমস্যা অন্যান্য খনির ক্ষেত্রেও। যথা, স্থানীয় আদিবাসী সমাজের আপত্তিতে নিয়মগিরি পাহাড়ের বক্সাইট খননের উদ্যোগ বানচাল হওয়ায় ওড়িশায় বেদান্ত সংস্থার অতিকায় অ্যালুমিনিয়াম কারখানা বিপাকে পড়িয়াছে। খনি-দুর্নীতির সমস্যা আছে কর্নাটকের মতো রাজ্যেও। দুর্নীতি অবশ্যই নিবারণ করা দরকার। স্থানীয় মানুষের আপত্তিও অগ্রাহ্য করিবার প্রশ্ন নাই। কিন্তু এই সব বাধা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মোকাবিলা করিয়া একটি স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন করা ও তাহা বলিষ্ঠ ভাবে রূপায়ণ করা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। ইউ পি এ সরকার সেই দায়িত্ব পালনে শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ। খনি একটি উদাহরণ, প্রশাসনিক অচলতার অন্য বহু নজির রহিয়াছে। এই ব্যর্থতার ফল ভুগিতেছে অর্থনীতি। বিনিয়োগ উৎপাদনক্ষমতা বাড়ায়। জ্বালানি ও অন্যান্য সামগ্রীর অভাবে সেই ক্ষমতা অব্যবহৃত থাকিলে বিনিয়োগ নিষ্ফল। বিনিয়োগ নিষ্ফল হইলে নূতন বিনিয়োগের উৎসাহও কমিতে বাধ্য, আজ না হোক কাল। সে ক্ষেত্রে আয়বৃদ্ধি দুই দিক হইতে মার খাইবে। হ্যারড-ডোমার মডেল ইতিহাস, কিন্তু তাহার অঙ্কটি আজও সমান সত্য। অঙ্কের মার হইতে নিস্তার নাই। |