তিন বছর আগে পুজোয় আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আর ফেরেনি ১৬ বছরের মেয়েটি। বহু খোঁজ করেও মেলেনি সন্ধান। গত শনিবার এক ব্যক্তির সঙ্গে মেয়ে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ায় চমকে ওঠেন বাবা-মা। জানতে পারলেন, অপরিচিত ওই ব্যক্তির কাছেই দিল্লিতে শেষ বার বিক্রি করা হয় তাঁদের মেয়েকে।
গত কয়েক মাস ধরে ওই তরুণীর খোঁজে দিল্লিতে বার বার যায় পুলিশ ও সিআইডি-র দল। সেই খবর চাউর হতেই সন্দেহ হয় ওই ব্যবসায়ীর। এর পরেই ‘মোটা টাকায়’ কেনা ১৯ বছরের মেয়েটির মুখে শোনেন তাঁর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে দিল্লির অন্ধকার জগতে পৌঁছনোর কাহিনি। সব শুনে মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে আসেন তিনি।
তরুণীকে তাঁর পিসি সীমা দাস দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন বলে অভিযোগ করেন তাঁর বাবা-মা। তিন বছর দিল্লি-সহ কয়েকটি জায়গায় হাত বদল হয়ে ঘুরেছেন তিনি। অত্যাচারের আতঙ্ক এখনও চোখেমুখে। শরীরে পোড়া, কাটার দাগ দেখিয়ে ওই তরুণী বলেন, “লোকগুলো খুব মারত। কথা না শুনলে গায়ে, হাতে সিগারেট চেপে ধরত। মাথায় গরম জলও ঢেলে দিয়েছিল।” তাঁর আরও অভিযোগ, পিসি তাঁকে দিয়ে নোংরা কাজ করাত। এক বছর এমন চলার পরে তাঁকে বিক্রি করা হয় মুম্বইয়ে এক ব্যবসায়ীর কাছে। সেখান থেকে জাহানাবাদ, পঞ্জাব ঘুরে ফের দিল্লির এক ব্যবসায়ীর কাছে তিনি বিক্রি হয়ে আসেন দিন পাঁচেক আগে।
কী ঘটেছিল তিন বছর আগে? আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাসিন্দা টুসু (নাম পরিবর্তিত) ২০১০-এর দুর্গাপুজোয় বাবা-মায়ের সঙ্গে লিলুয়ায় দমন দাস নামে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যান। দমন সম্পর্কে তরুণীর বাবার মেসো। দু’দিন পরে বাবা-মা ফিরে গেলেও তিনি দমনদের বাড়িতে থেকে যান। কিছু দিন পরে তাঁর বাবা ওই বাড়িতে ফোন করে শোনেন, দমনের মেয়ে সীমার সঙ্গে তাঁর দিল্লির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে টুসু।
তরুণীর বাবার অভিযোগ, ২০১০-এর ২৫ ডিসেম্বর দমন তাঁকে ফোনে জানান, সীমার দিল্লির বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছে টুসু। মেয়ের খোঁজে দিল্লি গিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয় তাঁকে। এর পরই তিনি লিলুয়া থানায় সীমা, দমন ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রীর নামে অভিযোগ দায়ের করেন। জানান সিআইডি-কেও। কিন্তু কিছুই হয়নি বলে তাঁর অভিযোগ।
২০১১-এর জুলাইয়ে বিষয়টি জানতে পারে রাজ্য মহিলা কমিশন। কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেন, “সিআইডি, হাওড়া সিটি পুলিশকে বহু বার চিঠি দিয়েছিলাম মেয়েটির খোঁজ করতে। কিন্তু সকলে উদাসীন ছিলেন। অগত্যা তাঁর বাবাকে আদালতে যেতে বলি।” ২০১৩-এর শুরুতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেন তরুণীর বাবা। তিনি বলেন, “লিলুয়ার স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিষয়টি জানাই।” রাজীববাবু বলেন, “সরকারও চাইছে নারী পাচার বন্ধ করতে। এই বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এর আগেও তিনটি মেয়েকে উদ্ধারে সহযোগিতা করেছি।” শেষে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে নড়ে বসে প্রশাসন। হাওড়া সিটি পুলিশের এক কর্তা বলেন, “ঘটনার তদন্ত চলছে।” সোমবার ওই তরুণী হাওড়া আদালতে গোপন জবানবন্দি দেন। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে দমন বলেন, “ওঁর বাবার কথাতেই মেয়েটি দিল্লিতে সীমার বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরে হারিয়ে যায়। আমরা ওঁকে কোথাও বিক্রি করিনি।” |