|
|
|
|
মোহন মশাইকে বলি, ‘হিংসা করিও না, খাটো... তোমারও হইবে’
বাঁ ভ্রু কুঁচকে শুনলেন প্রশ্ন। উত্তরে দুরমুশ দিলেন নিশানায়। বললেন, যখন রেডিওতে গান শুরু করেছেন,
তখন মোহন সিংহ বলে কারও নামই শোনেননি। চাঁচাছোলা কথা বললেন কবীর সুমন। শুনলেন সুমন দে |
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ পণ্ডিচেরিতে সাহানা দেবীর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে সাহানা দেবী বলেন স্বরলিপি দেখে গান হয় না। আজ যাঁরা বলছেন, রবীন্দ্রনাথের গান না শিখেও স্বরলিপি পড়ে গাওয়া যায়, তাঁদের কি সেটাই স্মরণ করিয়ে দেবেন?
আমাদের দেশ স্বরলিপি-নির্ভর নয়। আমাদের বিদ্যাশাস্ত্র সবই ‘গুরুমুখী’। মড্যুলেশন কি স্বরলিপিতে থাকে? গুরুর কাছে না শিখলে গান হবে না। আনন্দ প্লাস-য়ে মোহন সিংহের সাক্ষাৎকারটা পড়েছি। উনি যদি ভারতীয় রাগসঙ্গীতেই বিশ্বাসী হন, তা হলে আমার পাল্টা প্রশ্ন হবে এই, আমি একটা ছোট খেয়াল নোটেশন করে দিলাম। সেটা ‘পারফেক্টলি’ পড়ে দিলেই ‘খেয়াল’ হয়ে যাবে? হতে পারে? সম্ভব?
এখনকার বেশির ভাগ গান অশিক্ষিত গলার। মানেন আপনি?
শ্রীকান্ত আচার্য, রূপঙ্কর, লোপামুদ্রা, মনোময়। তার আগে ইন্দ্রাণী সেন, হৈমন্তী শুক্ল এঁদের ‘অশিক্ষিত’ গলা? কোন আক্কেলে কোনও মানুষ এই রকম কথা বলেন? এ কথাটা বলেন এই জন্য যে এঁদের গান যাঁদের ভাল লাগে, তাঁরা তবে কেউ নন। আগেকার শিল্পীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ তুলনায় না এলেও বলব এঁরা যোগ্য উত্তরসূরি। আজকালকার সব খারাপ, আর আগে সব ভাল ছিল আমি একদম বিশ্বাস করি না। আর রাগসঙ্গীত ছাড়া কিছু হবে না এ হয় নাকি? ছোটবেলার একটা অভিজ্ঞতা বলি। আমির খাঁ সাহেবের এক ছাত্রের বাড়িতে খাঁ সাহেবের গানের আগে জোরজার করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ‘অয়ি ভুবনমনমোহিনী’ গানটা গাওয়ানো হন। গান শেষ হলে আমির খাঁ হেমন্তবাবুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এর পর আমি কী গান গাইব? গান আপাতত বন্ধ। এখন চা খাওয়া হোক।’ এইটা আমার দেশ। আমার দেশের অসাধারণ বাউলশিল্পীরা কোন রাগসঙ্গীত শিখে আসেন ভাই? এঁদের অশিক্ষিত বলব?
তা হলে কেন এই ধরনের মন্তব্য? ঈর্ষা?
সম্পূর্ণ ঈর্ষা থেকে। আমার নামটা বলছেন কারণ বোধহয় সবচেয়ে বেশি ঈর্ষা করেন আমাকেই। |
|
অন রেকর্ড যাচ্ছি কিন্তু। লিখব তো?
হ্যাঁ। প্লিজ প্লিজ। মোহন সিংহের সাক্ষাৎকারটা পড়তে পড়তে আমার আগাগোড়া দুটো কথা মনে হয়েছে। বাসের পেছনে লেখা থাকে, ‘হিংসা করিও না, খাটো...তোমারও হইবে।’
আর দ্বিতীয় কথাটা কী?
একমাত্র বঙ্গভূমে ওই বাসের
পিছনেই দেখা যায় ‘দেখবি আর জ্বলবি। লুচির মতো ফুলবি।’ (অট্টহাসি) সবাই খারাপ। সব্বাই
ভুল আমিই ঠিক। কাউকে একটা
ভাল কথা বলা যায় না? আমরা বাঙালিরা এই রকমই। উনি তো ঠিক বাঙালি নন, তবু বাঙালি হয়ে গেছেন বোঝা গেল।
মোহন সিংহ বলেছেন তুমি নাকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘যা খুশি’ করো?
সম্পূর্ণ ভুল বলছেন। আহা রে, বেচারা মোহনবাবু। গানের সুর করতে আমি জানি। যেটা উনি জানেন না বোধ হয়। অন্তত এখনও পর্যন্ত কোনও পরিচয় পাইনি যে সিংহমশাই ‘পাগল’য়ের মতো একটা সুর করছেন। অর্থাৎ কবীর সুমনকে কারেক্টিভ দিতে হবে না। তাঁর থেকে বেশি গান আমি শিখেছি। আর আমি যখন গান করতাম রেডিওতে আমি কোনওদিন মোহন সিংহ বলে কারও নাম শুনিনি।
মূল প্রসঙ্গে ফিরি। তোমার কী মনে হয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনও চূড়ান্ত গায়কি থাকা সম্ভব?
একেবারেই না। একটা বড় গায়কি তৈরি হয়ে আছে। গুরুরা সেই গায়কিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এবং একজন অ্যাডভান্স ছাত্র তাঁর মতো করে শেডস দিয়ে দেবেন। যেমন আমি পঙ্কজ মল্লিক ঘরানার লোক। আজ শ্রীকান্ত আচার্য যখন গাইছেন আমি ওঁর মধ্যে পঙ্কজ মল্লিক ঘরানার অনুরণন দেখতে পাচ্ছি।
এইখানেই আপনার কাছে প্রশ্ন, যে কবীর সুমন বাংলা গানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, সেই লোকটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে এত দশকের চর্চা সত্ত্বেও কোনও ঘরানার দিক নির্দেশ করল না কেন?
না। এটা হয় না। কারণ, কবীর সুমনের পিতামাতারা আছেন। ঠিকই, আমার চেয়ে রাবীন্দ্রিক সঙ্গীতকার ত্রিভুবনে আর নেই। কিন্তু, রাজেশ্বরী দত্ত যেখানে খাপ খুলেছেন, সেখানে খাপ খুলব কী হে! ওই ঘাটে বাঘ আর কুমিররা ঘোরাফেরা করছে। তার পর কবীর সুমন! পঙ্কজকুমার মল্লিক, সাহানা দেবী, হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিনয় রায়, সলিল বসু, সুচিত্রা মিত্র, কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়একের পর এক। ভীমনাগের কড়াপাকের পর আমি কবীর সুমন, নাগ কড়াপাক বানাব কী করে? |
সবিস্তার... |
অতএব বিশুদ্ধবাদী কবীর সুমন আজ সোমলতারা যে ভাবে গাইছেন তাকে সমর্থন করেন না।
আমি সমর্থন করি না। গানটা শিখুক। এফেক্টস প্রসেসরের সাহায্যে নয়। পিচ কারেক্টারের সাহায্যেও নয়। গান কী দোষ করেছে? রবীন্দ্রনাথ কী দোষ করেছেন যে, তা শিখতে হবে না?
কী আশ্চর্য! ১৯৯৬ সালে যে লোকটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইতিহাসে প্রথম, রেকর্ডিং ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে প্রথম, অ্যাকুয়স্টিক নাইলন স্ট্রিং গিটারে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিল, সে এ যুগের এক্সপেরিমেন্ট মেনে নেবে না কেন? রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিধুজ্যাঠার মতো শোনাচ্ছে না কথাগুলো!
না, গিটারে গেয়েছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানটা রবীন্দ্রনাথেরই গান ছিল। তার সুর ঠিক ছিল, স্বরপ্রক্ষেপ ঠিক ছিল, একটা পরদারও এ-দিক ও-দিক হয়নি। ধরো আমি কেমিস্ট্রির লোক এক্সপেরিমেন্ট করছি, টিউবওয়েলের জলের সঙ্গে আবির ও ফাগগোলা জল মিশিয়ে এটা এক্সপেরিমেন্ট নাকি?
ফিল্মে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ও নয়?
ওটা কোনও এক্সপেরিমেন্টই নয়।
ওই ‘হুল্লাহুল্লাহু’ করলেই হল!
‘পাগলা হাওয়া’ মানে তো হাওয়াটা পাগল, তুমি পাগল নও। বিশেষণ তোমার বা তোমার পিতৃপুরুষের ওপর তো নয়!
‘তাসের দেশ’য়ে কিউ-য়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত কেমন লাগল?
কিউয়ের গানের গলা যে এত সুন্দর আমি জানতাম না। কিউ গানটাকে আর একটু শিখুন, চর্চা করে গান করুন। আমরা এক ভাল কণ্ঠ পাব। কিন্তু
কিউ যখন ‘এলেম নতুন দেশে’ গান, তখন সুরটা পাল্টানো ঠিক হয়নি।
এটা করা তো চলবে না। এটা নতুনত্ব নয়। রবীন্দ্রনাথের গান একটা ধাঁচায় আছে, আমি সেটাকে নতুন করে কী করতে পারি? তা হলে তো নিজে গান তৈরি করাই ভাল। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরগুলো সিরাজ-উদ-দৌলার আমলের, এটা কে বলেছে! ওগুলো সমকালীনই। তবে আমার আর রবীন্দ্রনাথ পড়তে মোটেই ভাল লাগে না, সোজা কথায় অসহ্য রকমের বাজে লাগে অধিকাংশ সময়ে। কিন্তু তিরিশ- চল্লিশটা গান শুনে মনে হয় ‘বি অল অ্যান্ড এন্ড অল’ অফ মাই লাইফ। উনি ডিফাইন করে দিয়েছেন সভ্যতাকে। এটাই কসমস। |
|
|
|
|
|