কৌশিকের ধৈর্যপাথর

কোন জ্যোতিষী? কী পাথর?
হাঃ হাঃ হাঃ।

হাঃ হাঃ হাঃ কী? বেহালার সেই জ্যোতিষী নাকি, যার কাছে ইন্ডাস্ট্রির অনেকে যায়টায়?
না না।

তা হলে অন্য কেউ? অন্য কারও দেওয়া পাথর?
একটাই পাথর। ধৈর্যপাথর! আমার এক সহকর্মী বলেছিল, যত বছর যত সময় ধরে আমাকে ও শ্যুটিং করতে দেখেছেসে সিরিয়াল কী টেলিফিল্ম, কী মেগা সিরিয়াল, কী ফিল্ম! তাতে বয়স অনুযায়ী অনেক দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছি। চোদ্দোটা বছর দাঁড়াতে হল তো!

শুনেছি আপনার কুসংস্কার হল, গাড়িতে উঠছেন। তার পর ড্রাইভার গাড়ি ব্যাক করে আবার সামনে নিয়ে যাচ্ছে এমন কখনও হতে দেন না। গাড়ি পুরো রিভার্স হলে তবেই আপনি উঠবেন।
ঠিক। দিনের শুরুতে পিছোতে চাই না। ওটা আমার কাছে একটা সুপারস্টিশন। গাড়িটা খুব প্রতীকী মনে হয়। মনে হয় সকালের জার্নিটা অন্তত ফরওয়ার্ড মুভিং হোক। জানলেন কী করে এটা?

সেটা থাক। কিন্তু আপনার কেরিয়ার যদি দেখেন, ব্যাকে তো যেতে হল। এতগুলো বছর আর অসফল সব ছবি নিয়ে।
ঠিকই। ব্যাকে যেতে হল। বললাম না, চোদ্দো বছর ওয়েট করলাম! এর মধ্যে টিভিতে দেড়শোর কাছাকাছি প্রজেক্ট রয়েছে। দশ-এগারোটা ফিল্ম রয়েছে। তার-পর... সেই ধৈর্যপাথর!

চিচিং ফাঁক পেতে এত দেরি হল কেন?
কোনও ব্যাখ্যা নেই। যত বার বেশি ক্যালকুলেট করতে গিয়েছি, তত ‘ফেল’ করেছি। যত দর্শকের ভাল লাগার মেজাজটা ধরতে গিয়েছি, তত বাজার থেকে আউট হয়ে গিয়েছি।
এখন সুইডেনে কৌশিক
ফ্লপমাস্টার ডিরেক্টর মনে হত নিজেকে?
ফ্লপ করে যাচ্ছি ক্রমাগতসেই ফিলিংসটা হয়নি। কেউ কখনও আমাকে দূর ছাই করেনি। তবে অ্যাভারেজ রান সব সময় ৫৫-৬০ থেকে যাচ্ছিল। বাড়ছিল আর না। টিম থেকে বাদ যাচ্ছিলাম না। কিন্তু...

কিন্তু ধামাকাটাও হচ্ছিল না।
ঠিক।

‘আর একটি প্রেমের গল্প’ ভাল চলেছিল। অথচ সবাই বলল, ‘এটা তো কৌশিকের হয়ে ঋতুপর্ণই ডিরেকশন দিয়েছে!’
মজাটা দেখুন, সেই কবে ২০০৩য়ের কাছাকাছি সেম বিষয় নিয়ে আমি টেলিফিল্ম বানিয়ে ছিলাম‘একটু উষ্ণতার জন্য’। সমকামী সম্পর্ক নিয়ে সেটাও ছিল। ওটা ছিল মহিলা। এটা পুরুষ। যেহেতু ঋতুদা নিজে অভিনয় করেছিলেন, তার পোশাকআশাক, অঙ্গসজ্জা, আর্ট ডিরেকশন সব কিছু একটা নিদিষ্ট স্টাইলের ছিল। লোকে বলতে শুরু করল মোটেও কৌশিকের ডিরেকশন নয়।
তখন মন খারাপ না করে আমি ভাবার চেষ্টা করলাম একই জিনিস তো আগেও হয়েছে। ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’ যখন অপর্ণা সেন বানালেন, লোকে বলল ওঁর হয়ে সত্যজিৎ রায় বানিয়ে দিয়েছেন। আবার ঋতুদা যখন ‘উনিশে এপ্রিল’ বানাল, লোকে বলল অপর্ণা সেনই আসল ডিরেক্টর। ঋতু কী করে প্রথমেই এত ভাল ছবি বানাবে।

অপেক্ষাটা তাই থেকেই গেল।
ওয়েটিংটা থেকেই গেল। পয়সাকড়ির দিক থেকে সমস্যাটা তো ছিলই। রোজগারপাতি কোথা থেকে নিরাপত্তা জোগানোর মতো হবে? আমি তো আর বছরে একাধিক ছবি করছি না। মেন্টালিও প্রচণ্ড খোঁচা দিত। আমার বাবা বিখ্যাত গিটারবাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সাকসেসফুল লোকের সন্তানদের মতো আমিও ফেলিওর দেখিনি। কিন্তু নিজে সাকসেস পাওয়ার রাস্তাটা পেতাম না। খুব বিভ্রান্ত লাগত জানেন? মনের মধ্যে অবিরাম ক্যালকুলেশন চলত। কোনও ছবি হিট হলে তার রেসিপিটা বার করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যেতাম। ছবির কোনটা ওয়ার্ক করল? কোনটা আমি কপি করতে পারি? কোনটা আমি বুঝতে পারছি না? নিজে যেহেতু স্ক্রিপ্ট লিখি, বিড়ম্বনাটা শুরু হত আগেই। ব্যাটসম্যানের হয় না? কোন শটটা খেলব, কোনটা খেলব না? শটের প্ল্যানিংটা কী হবে তাই বুঝে পেতাম না। একবার ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলাম আমার ছবি নিয়ে। ফেরার পর দেখলাম প্রোডিউসর আমার মোট ফিজ থেকে টিকিটের টাকাটা কেটে নিয়েছে। স্তম্ভিত লেগেছিল। এ ভাবে কি লোকে টাকা কেটে নেয় নাকি? কিন্তু কাকে বলব? কে তখন আমার কথা শুনবে?

দিশেহারা এই ফেজটাতে বাড়িতে চূর্ণীর রোল কী ছিল?
চূর্ণীও খুব ধৈর্য ধরেছিল। মানসিক ভাবে ও অসম্ভব ধৈর্যশীল। ইন্ডাস্ট্রি থেকে ওর মতো একজন অভিনেত্রী এত বছর ধরে কত অবহেলা পেয়েছে। ওকে আমার ছবিতে নেওয়া হলে লোকে প্রশ্ন করেছে কেন নিচ্ছ? চূর্ণী ওয়াজ ভেরি সাপোর্টিভ আমার জন্য। ‘শব্দ’তে তারকের কাস্টিংটা কিন্তু ওরই করা। ও-ই বলেছিল, ‘ঋত্বিককে নাও।’

একটু আগে বলছিলেন, ক্রিকেটের মতো করে ভাবতেন কোন স্ট্রোকটা খেলব। কোনটা খেলব না? কমপিটিটিভ স্পোর্টস কিন্তু শেখায়, সংশয়ে পড়লে বড় প্লেয়ারও সেফ খেলবে। ব্যাটসম্যান সাইড শট না খেলে সোজা খেলবে। ফুটবলার একদম ড্রিবল না করে পাস দেবে। টেনিস প্লেয়ার ডাউন দ্য লাইন না মেরে কোর্টে সোজা বল রাখবে। অথচ আপনি চোদ্দো বছরের অভিজ্ঞতাবিদীর্ণ একটা মানুষ নিরাপদ না থেকে বানিয়ে ফেললেন কিনা ‘শব্দ’।
ওই যে সেফ ক্যালকুলেশনগুলো যখন একটাও কাজ করছিল না, তখন মনে হল নিকুচি করেছে। এনাফ ইজ এনাফ! আমি নিজে যেটা বানাতে চাই সেটাই বানাব। একটা বন্য স্বাধীনতা দরকার আমার। কোনও কিছু আর ভাবব না। ফুল পার্সোনাল ফ্রিডমে চলব।

‘শব্দ’র তারক যেমন একটা সময়ে গিয়ে কাউকে কোনও পাত্তা না দিয়ে রাগী মুখে একলা দাঁড়িয়ে থাকে। ওই একা বন্য লোকটাই কি নতুন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়?
ঠিক তাই। দীর্ঘ এত বছর অন্যের মর্জিমতো চলে যে এ বার নিজের খেয়ালে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। আমি যেটুকু বলতে চাইছি এখন থেকে সেটাই ইম্পর্ট্যান্ট! তুমি কী বলছ জানতে আমি আর আগ্রহী নই। আমি আর তোমার মশালা বানাব না।
‘অপুর পাঁচালি’: শ্যুটিং শেষ ১২ দিন ২৪ শিফটে। বাজেট- ৮০ লাখেরও কম।
আর ম্যাগি নুডলস নয়।
নাহ (হাসি)। আর ম্যাগি নুডলস নয়।

প্রথম দশটা ফিল্মের মধ্যে ম্যাগি ক’টা আছে?
তিন-চার প্যাকেট তো আছেই।

ব্যর্থতার এই লম্বা ফেজের ভেতর যখন টোনির ছবি স্বর্ণকমল পাচ্ছিল, যখন সৃজিত পরের পর হিট দিচ্ছিল, তখন নিশ্চয়ই বুকের ভেতরটা আরও দাউদাউ করে জ্বলছিল?
না, না, তা কেন?

কাম অন কৌশিক। একটা হিংসে হওয়া তো খুব স্বাভাবিক যে আমি সেই কবে ১৯৮৭য়ে স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে জীবন শুরু করে আজও ডিরেক্টর হিসেবে ঘষটাচ্ছি। অথচ তোরা এলি আর পেয়ে গেলি?
তা কেন? ‘অটোগ্রাফ’ দেখে তো আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। এত ঝকঝকে আঙ্গিকে বানানো। বা ‘বং কানেকশন’ দেখে তো অসাধারণ লেগেছিল! আই ওয়াজ ভেরি ইমোশনাল। আমি অঞ্জনদাকে ফোন করে বলেছিলাম, কী করেছ তুমি! ফ্ল্যাগটা কোথায় পুঁতে দিলে নিজেই জান না!

টালিগঞ্জের নিউ এজ ডিরেক্টরদের একটা
র‌্যাঙ্কিং করুন। আপনি, সৃজিত, শিবপ্রসাদ, কমলেশ্বর, অঞ্জন, মৈনাক, টোনি কে কত নম্বরে?
ওরে বাবা!

ওরে বাবা কেন?
এটা করা যায় নাকি? হয় না...

করুন না, ছবি বানানোর মতোই একটা বন্য স্বাধীনতা নিন।
নাহ, সবাই তাদের নিজের জায়গায় এক নম্বর। সবাই তাদের মতো করে বেস ক্যাম্পে আছে। সবাই যার যার মতো ট্রেক করছে ওপরে যাবে বলে।

নিরামিষ উত্তর।
ওকে। একটা লাইন অ্যাড করছি। প্রত্যেকে নিজের মেজাজ মতো, নিজের রুচিমতো ভাল। কিন্তু কারও উচিত নয়, নিজের সেই ঘরানার বাইরে গিয়ে তমুকের মতো হতে চেষ্টা করা।

খোঁচাটা বোঝা গেল। কিন্তু একটা কথা বলুন, ‘অপুর পাঁচালি’ কি সত্যি তেরো দিন আর মাত্র আশি লাখ টাকায় করা ছবি?
১২ দিন ২৪ শিফ্ট। আর ৮০ লাখের কমই লেগেছে হয়তো।

কী ব্যাখ্যা হয়? পুরো ‘ফ্রিক’ কেস তো!
একটাই বোধহয় ব্যাখ্যা সময়! আমি জ্যোতিষে অন্ধ বিশ্বাস করি না। কিন্তু সময়ে করি। সব কিছুর বোধহয় একটা সময় থাকে!

‘অপুর পাঁচালি’তে আপনার এত বড় পুরস্কার জেতা। সেই ফিল্মের প্রোটাগনিস্ট কিনা পরমব্রত। যাঁকে ঘিরে একটা সময় আপনার পরিবারের তীব্র স্টিফনেস ছিল। এটাও তো এক রকমের পোয়েটিক জাস্টিস?
পরমের সঙ্গে আমাদের বিউটিফুল সম্পর্ক। ও আমাদের পারিবারিক বন্ধু এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মাঝখানে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। সে তো পরিবারে থাকতে গেলেও হয়। তার পর সংশ্লিষ্ট মানুষেরা অত্যন্ত গ্রেসফুলি পুরো ব্যাপারটা হ্যান্ডল করেছেন। পরম আমাদের পরিবারে আজও ভীষণ সমাদৃত।

আপনাকে তো ইন্ডাস্ট্রিতে ডাকা হয় কে জি! কৌশিক গাঙ্গুলির শর্ট ফর্ম?
হুঁ।

কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে তো আপনার আরও একটা নাম আছে ‘লাভ গুরু’।
এই রে। বাউন্সার।

তা কেন? এটা তো সত্যিই যে ইন্ডাস্ট্রির কিছু নামী কমবয়সি নায়িকা আর কোনও উঠতি নায়ক তাদের প্রেমজনিত সমস্যা আপনাকে নিয়মিত খুলে বলে। তখন আপনি গুরু হয়ে তাঁদের মানসিক জরিবুটি দেন।
কর্মক্ষেত্রে কারও যদি কোনও সমস্যাটমস্যা হয় সে খুলে বলে। তখন দাদার মতো মতামত দিই আর কী।

কর্মক্ষেত্র কোথায়? প্রেমক্ষেত্র বলুন।
আমি কিছু ইম্পোজ করি না। সবটা মন দিয়ে শুনি। পাশে থাকি। তার হয়ে কাউকে কিছু বলার হলে সেটা উচ্চারণ করে দিই।

মনে করা যাক, আমি একজন উঠতি নায়িকা। পার্টিতে মদটদ খেয়ে তার পর রাত্তিরে কী হল, না হল, আমার ভাল করে মনেও নেই। কিন্তু সকালে উঠে মনে হচ্ছে ছেলেটাকে আমার যেন ভাল লাগছে। এ বার ‘লাভ গুরু’ কী পরামর্শ দেবেন?
কী হচ্ছেটা কী? হাঃ হাঃ হাঃ।

শোনা যায়, এ রকম কেস আপনি নিয়মিত পান। প্রেমের দুর্দশা।
হুম। আমি বলি কাল রাত্তিরে যেটা করেছ তাতে কি তোমার কোনও ‘গিল্ট কমপ্লেক্স’ হচ্ছে? মনে হচ্ছে কাউকে ‘হার্ট’ করেছ বা নিজে অস্বস্তিতে ভুগছ? তা হলে কোরো না। আর যদি সে সব না থাকে, চালিয়ে যাও। এগুলোর কোনও সংবিধান হয় না।

লম্বা ইন্টারভিউ দিতে কি অসুবিধা হচ্ছে? ঠান্ডা কেমন সুইডেনে?
এখানে এখন মাইনাস ছ’ডিগ্রি! হাত-পা টনটন করছে। তিনটে-চারটে গরম জামাও এনাফ নয়। দিনে সবার শুধু মুখ আর রাতে চোখ দেখা যাচ্ছে। বরফ পড়া শুরু হয়েছে। জল জমে বরফ। খুব চাপ না-হলে কেউ বাথরুম যাচ্ছে না।

ট্যাক্স ফ্রি এই যে কুড়ি লাখ গোয়া থেকে জিতলেন। আমাদের কত দেবেন?
মানে?

মানে এই যে ছবির লাকি হেডলাইনটা আনন্দplus থেকে পেলেন। ‘অপুর পাঁচালি’।
সেটা ঠিক (হাসি)। আপনাদের বিভাগে যখন স্টোরিটা বার হয়, আমি ছবির নাম তখনও ঠিক করিনি। লেখার সঙ্গে হেডলাইনটা দেখে মনে হল, ‘অপুর পাঁচালি’টা তো বেশ হয়। তখন আনন্দplus থেকে নিই। অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা। আনন্দplus টিমের বড়ো খাওয়া পাওনা থাকল!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.