|
|
|
|
এখনকার বেশির ভাগ গানই অশিক্ষিত গলার |
তাঁর আপত্তি অনেক কিছু নিয়ে। সব চেয়ে তীব্র আপত্তি রবীন্দ্রনাথের গানের ‘কালোয়াতি’ হতে দেখলে।
সেই তালিকায় বিখ্যাত নামেদেরও বাদ দিচ্ছেন না উত্তেজিত মোহন সিংহ।
সাক্ষাত্কার নিতে গিয়েছিলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় |
পুরস্কার পেতে কি দেরি হয়ে গেল?
বেশ অনেকটাই দেরি হয়ে গেল। তাও যে বেঁচে থাকতে থাকতে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার পেলাম এটাই অনেক। এখন তো মৃত্যুর পরেই মানুষকে নিয়ে যত বাড়াবাড়ি।
আপনার ছেলে বিক্রমের ক্ষেত্রেও কি তাই হয়েছে?
একদম তাই। আমার ছেলে বলে নয়, আমি মনে করি বিক্রম নতুন প্রজন্মের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়কদের মধ্যে সেরা ছিল। জীবিত অবস্থায় সে কোনও অনুষ্ঠানে ডাকই পেত না। অথচ তার মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে, তার গান নিয়ে কি আদিখ্যেতা। ওর গান বিক্রিতে ভাল ব্যবসাও হয়েছে। কিন্তু ও কোনও টাকাই পায়নি। এই ঘটনাটা অবশ্য আমার কাগজে পয়সা দিয়ে বিজ্ঞাপন করে জানানো উচিত ছিল। যাতে ওই মিউজিক কোম্পানি সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলায়। শান্তিনিকেতনে বসে প্রতিবাদ করলে কাজ হয় না।
শান্তিনিকেতনেই বসে রইলেন কেন? এর ফলে কলকাতায় অনুষ্ঠান করার সুযোগও তো হারালেন...
পয়সা দিয়ে হল ভাড়া করে অনুষ্ঠান করব বলে আমি গান করি না। কেউ ডাকে না, তাই কলকাতায় আমার অনুষ্ঠান হয় না। হয়তো আমার গান কলকাতার লোকের হজম হয় না।
আপনি বড় শক্ত গান করেন। সেই কারণেই কি আপনার গান লোকের হজম হয় না?
আমি শ্রোতাভঞ্জনের জন্যে রবীন্দ্রনাথের গান করি না। আর সেই কারণেই বিশ্বভারতীতে চাকরি করছি। নিজের গানের প্রচারের চেয়ে রেওয়াজে আমার ভক্তি বেশি। আমি অল্পশ্রুত গান গাইতেই ভালবাসি।
বলা হয় মোহন সিংহ খাঙ্গুরা রবীন্দ্রনাথের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদলে ভারী গান গাইতে পারেন, ‘ভালবাসি ভালবাসি’ জাতীয় গান গাইতে পারেন না। এটা কি ঠিক?
ভারী গান বলে কিছু হয় না। গান শেখাটা টিয়াপাখির বুলির মতো নয়। আজকাল যদিও এমনটাই হয়। একশোটা গান শিখে, একশো এক নম্বর গানটা আড়া চৌতাল হলেই শিল্পীরা পাতা উল্টে যান। এটা কেন হবে?
কিন্তু আপনি রাগাশ্রয়ী গানই বেশি গান। এটাই বা কেন হবে?
আমি সব গানই গাইতে পারি, কিন্তু ‘ভালবাসি ভালবাসি’-র চেয়ে ‘জাগে নাথ জোছনারাতে’ গানটাতে রবীন্দ্রনাথকে আমি অনেক বেশি করে পাই। ‘ভালবাসি ভালবাসি’ লোকে অনেক শুনেছে। তাই ‘তুমি জাগিছ কে’ বা ‘অসীমকালসাগরে’-র মতো
না-শোনা গান শোনাতে চাই।
|
|
কিন্তু শ্রোতারা কি শোনে? আজকের প্রজন্ম তো রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলেই নাক সিঁটকোয়। আপনার কি মনে হয়?
এটা সম্পূর্ণ ভুল। স্কুল আর কলেজের ছাত্ররাই আমার গানের সব চেয়ে বেশি ভক্ত। আসলে গানের ক্ষেত্রে স্বরজ্ঞান আর লয়টা সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন বেশির ভাগ গানই লোকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গায়। লোকে শুনবে কেন? শান্তিদেব ঘোষ যাকে বলতেন ‘অশিক্ষিত গলা’। গানের বাণীতে, সুর আর লয়ের মেজাজ থাকলেই সেই গান শ্রোতাদের মন টানবে।
অনেকে বলে আপনি শান্তিদেব ঘোষকে নকল করেন। এটা কি সত্যি?
এটা একদম ভুল। আমি কোনও দিন কাউকে নকল করিনি। আমি শান্তিদার গান সামনাসামনি প্রচুর শুনেছি। তবে ওঁর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখিনি।
তাহলে রবীন্দ্রসঙ্গীতে আপনার শিক্ষাগুরু কে?
আমি রবীন্দ্রনাথের গান কারও কাছেই শিখিনি। আসলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দীর্ঘ অধ্যবসায়ের জন্যে, আমি চিঠির মতো করে স্বরলিপি পড়তে পারি। স্বরলিপি থেকে গানের ডাইমেনশনটা খুঁজে বার করলেই গানের কথা অনুযায়ী লয়টা বেরিয়ে আসে, ভাব ফুটে ওঠে।
তাহলে আপনি বলতে চাইছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা জরুরি, কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা থাকলে রবীন্দ্রসঙ্গীত না শিখলেও চলে?
অবশ্যই। শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতই নয়। যে কোনও গান গাওয়ার ক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা আবশ্যক। রবীন্দ্রনাথ সেটা মানতেন বলেই শান্তিনিকেতনে শিক্ষিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুরুদের এনেছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষা থাকলে, ইচ্ছে থাকলে, রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া যায়।
তাহলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঘরানা?
ঘরানা তো একটাই। রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে অনুসরণ করলেই হল।
এখনও কি শান্তিনিকতনে পুরনো পদ্ধতি মেনে গান শেখানো হয়?
শান্তিনিকেতনে এখন কেবল স্বরলিপি গাওয়া হয়। প্রচুর ছাত্রছাত্রী, কিন্তু বেশির ভাগের মধ্যেই কোনও স্থিরতা নেই। গান গাইতে গেলে জীবন দিতে হয়। আজকাল এ ভাবে কেউ তো গানটাকে নিতেই পারে না। অনুষ্ঠানে পয়সা পাওয়া আর সিডি করার জন্যে লোকে গান শেখে। এমনকী এখন তো গান শিখে, পয়সা দিয়েও লোকে অনুষ্ঠানে গায়!
আপনি কি সঙ্গীত ভবনে রবীন্দ্রনাথের গান শেখান?
না। বিশ্বভারতী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে আমায় কোনও দিনই গ্রহণ করেনি। আমাকে দায়িত্ব দিক না। আমি চাই সেটা। তাতে অন্তত রবীন্দ্রনাথের গানের মানকে আমি যথাযথ জায়গায় নিয়ে যেতে পারব। বেসুরো লয়হীন গানে প্রাণ সঞ্চার করতে পারব।
শান্তিনিকেতনে ক্যাফে কফি ডে-র মতো কফি শপ হলে আপনি আপত্তি করবেন?
হ্যাঁ করব।
কেন করবেন?
কারণ সেই কফি শপে মস্তানদের আড্ডা বসবে। বিশ্বভারতীর প্রফেসর, লেকচারারদের আড্ডা বসবে না। শান্তিনিকেতন এখন ফালতু লোক আর রজত রায়ের তৈরি লক্ষ টাকার দেওয়ালে পরিণত হয়েছে। নাট্যঘর, উত্তরায়ণের বেড়া টপকে আজ আর আমি ঢুকতে পারি না। কালোর দোকানও পরনিন্দায় কোণঠাসা। চোর ঠেকাতে দেওয়াল তুলে দেওয়ালের পিছনেই চোরেদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে।
তবে কি রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ গানটাও আপনার গাইতে মন চায় না?
নাহ্। আমি তো এখনকার ভাইস চ্যান্সেলরকে বলেছি ওই গানটা বদলে দিতে।
রবীন্দ্রনাথের গানের বদল তাহলে আপনি মেনে নেবেন?
কখনওই না।
নিউ এজ বাংলা ছবিতে যে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানকে ব্যবহার করা হচ্ছে লোকে তো নিচ্ছে, আপনি কেন আপত্তি করছেন?
রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা আমায় ‘মায়াবনবিহারিণী’ গানটার কথা বলেছিল, শুনেছি আমি। আর ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’-ও শুনেছি। খুব বাজে লেগেছে। এখনকার কম্পোজারেরা নিজেরা কি গান লিখতে বা সুর দিতে পারেন না? এরা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাঁচেও না, আবার রবীন্দ্রনাথকেই এ ভাবে মারছে! সরকার থেকেও কোনও কিছু বলা হয় না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে যা খুশি করে।
এঁরা বলতে কাদের বোঝাতে চাইছেন?
কেন? কবীর সুমন। টেলিভিশনে গিটার হাতে ওঁকে বলতে শুনেছি রবীন্দ্রনাথ গানের এই অংশে সুরটা যদি এইভাবে লাগাতেন....নিজের গান নিয়েই বলুক না এসব!
আপনি অজয় চক্রবর্তীর মতো রবীন্দ্রনাথের গানের মাঝে তান গাইতে চাইবেন না?
অজয় চক্রবর্তী আমার খুব ভাল বন্ধু, পছন্দের শিল্পী। কিন্তু ওঁর রবীন্দ্রনাথের গানের মাঝে তান দেওয়া গান আমি শুনতে চাই না। তানের কালোয়াতি করতে চাইলে তো আমি খেয়াল গাইব।
তবে কাদের গান শোনেন আপনি?
দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিদেব ঘোষ, সুবিনয় রায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, সুচিত্রা মিত্র, গীতা ঘটক।
আর এই সময়ের কোন শিল্পী?
সময় বুঝি না। আমি কেবল এঁদের গানই শুনি। আর হ্যাঁ,অবশ্যই কিশোর কুমার।
দেবব্রত বিশ্বাস?
প্রথম দিকে ওর অসাধারণ গলা ছিল। দারুণ গান গাইতেন। কিন্তু বিশ্বভারতীর ওপর রেগে যাওয়ার পরে উনি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কালোয়াতি আরম্ভ করলেন, সেটা আমার ভাল লাগেনি।
কিন্তু মোহন সিংহ যে অসাধারণ পঞ্জাবি টপ্পা গান সেটা তো কেউ জানলই না?
আমি নিজে পয়সা দিয়ে তো গান রেকর্ড করব না। এইচএমভি বলেছে হিন্দি গান কলকাতার বাজারে চলবে না। লুধিয়ানা, দিল্লিতে আমি পঞ্জাবি টপ্পার অনেক অনুষ্ঠান করেছি।
রবীন্দ্রনাথের গান আপনার সঙ্গী ছিল বলেই কি বিক্রমের অকালে চলে যাওয়াকে মেনে নিতে পেরেছিলেন?
রবীন্দ্রনাথের গানে লাউড কিছুর জায়গা নেই। যতই আজকাল বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সেটাকে ‘ক্যাচি’ করে তোলার চেষ্টা হোক না কেন। এই গানে আনন্দ বা শোকের প্রকাশ গভীর। আমার জীবনও সেভাবেই এগিয়ে গেছে।
এই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কিছু ভাবছেন?
রবীন্দ্রনাথের গানের শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে একটা বই লিখছি আমি, তবে বই লিখে কী হবে? কেউ পড়বে? আমাকেই দেখছি এ বার ডান্ডা হাতে কলকাতায় গিয়ে বসতে হবে।
আর একটু পিআর-ও করতে হবে....
সত্যিই, একটু মিডিয়ার কাছাকাছি থাকতেই হবে।
এই এগোনোর পথে যদি মন কেমন হয় কী করেন?
একলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাই। আর ফিরে এসে গান গাই। |
|
|
|
|
|