পাওলি, নাইট লাইফ আর গোয়ার ভূতগুলো
ছোটবেলায় বাচ্চাদের অন্যতম বিনোদনের রসদ ছিল শাঁকচুন্নি আর ব্রহ্মদত্যির গল্প।
রাজা, রানি, টুনটুনিদের সঙ্গে শেওড়া গাছ থেকে ঝুলে পড়ে ব্রহ্মদত্যি আর শাঁকচুন্নিরাও ভিড় জমাত বাচ্চাদের মনে।
কিন্তু ২০১৩-তে?
বাচ্চারা এখন কতটা ব্রহ্মদত্যি আর শাঁকচুন্নিদের ভয় পায়, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। তবে প্রাপ্তবয়স্করা যে আজও ব্রহ্মদত্যি বা শাঁকচুন্নিদের থেকে বিনোদন পেতে আগ্রহী, তা গোয়াতে পার্টি করতে না এলে বোধহয় বোঝা যেত না।
এমন একটা ডান্সফ্লোরে যাওয়া হল এক রাতে, যেখানে যেই ঢুকবেন, তাঁকে ঠিক শাঁকচুন্নির মতোই দেখতে লাগবে!
সোজা ভাষায় যেই সেখানে ঢুকবেন, অমনি তিনি রূপকথার সেই চিরপরিচিত চরিত্রদের মতো দেখতে হয়ে যাবেন। শরীরের সব অংশ কুচকুচে কালো। শুধু চোখের মণি আর দাঁতগুলো ঝিলমিল করবে মায়াবী আলোতে!
এক কথায়, নিউ এজ শাঁকচুন্নিদের হটস্পট যাকে বলে।
তবে গত রবিবার মধ্যরাতের পর সব কাজ সেরে যখন পাওলিকে নিয়ে গাড়িটা ধেয়ে চলল ক্লাব কাবানা-র দিকে, তখনও ভূতপ্রেতের কথা মাথায় আসেনি।
নিশুতি, নিঃঝুম রাস্তা। মাণ্ডবী নদীর ওপরের ব্রিজ পার হতেই গাড়ির গতি আরও বেড়ে গেল। গাড়ির কাচ নামিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল নদীর ওপর ভেলার মতো দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মিনি জাহাজ। এগুলোই গোয়ার ক্যাসিনোর ঠেক। দোতলায় ডেকের পাশের অংশে হঠাৎ জ্বলে ওঠে নীল আলো। তার পর সেটা ঢেউ খেলিয়ে মিলিয়ে যায়। এর পর হলুদ আলোর ছটা। তার পর লাল...
এ যেন এক অন্য রাজ্য। মায়াবী দুনিয়া।
ভেসে আসে গান।
তবে সে রাতে ক্যাসিনোর হাতছানিতে সাড়া দেওয়ার সময় নেই।
গাড়ি চলতে থাকে। পাশে অঞ্জুনা, বাগাতোর বিচ ছাড়িয়ে।
বেশ কিছু ক্ষণ যাওয়ার পর মাথার ওপর দেখতে পাওয়া যায় স্পটলাইট। গোল গোল করে ঘুরে যাচ্ছে আলোর ছটা। কখনও আকাশের দিকে তাক করে, কখনও মাটিতে।
গাড়ির চালক জানান ওটাই নাকি কাবানা-য় অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো বাতি।
সামনে আরও খানিকটা এগিয়ে একটা ছোট চড়াই রাস্তা। কিছুটা গিয়ে গাড়ি আর এগোবে না। হেঁটে উঠতে হবে।
রিসেপশনে প্রথম প্রশ্ন: ‘দু’জন মেয়ে ভিতরে যাবেন?’
না, মানে...
কী মনে হল জানি না, ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না। এন্ট্রি ফি-টা দেওয়ার পরেই বললেন, “কই, হাতদু’টো দেখি। স্ট্যাম্প দিয়ে দিই।”
স্ট্যাম্প লাগিয়ে তৈরি।
একটা সিল্কি স্যাটিনের গোল পর্দা মতো জায়গা তৈরি করা হয়েছিল রিসেপশনের ঠিক পাশেই। সাদা আলোর একটা বিম। পিছনে গোলাপি আভা।
এই পর্দার পাশ কাটিয়ে চলে যেতে হয় ক্লাবের অন্দরমহলে।
সেখানে পরিবেশ একদম আলাদা।
নিভু নিভু আলো। পিছনে এঁকে বেঁকে উঠে যাওয়া পাথরের সিঁড়ি। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট বেঞ্চ। সেখানে বসে কপোত-কপোতীরা।
কখনও বাঁ দিকে বড় দালান। কখনও সামনে তাকিয়ে মনে হয় যেন বহু দূর সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে। একটু এগোতে গিয়েই পা আটকে যায়।
এটা তো সিঁড়ি নয়! আয়না! এত বড় প্রতিবিম্ব দেখে বোঝা দায় যে ওটা নিছকই ভ্রম।
মনে পড়ে গেল সইফ আলি খান অভিনীত ‘গো গোয়া গন’ সিনেমার কথা। যেখানে তিন জন অল্পবয়সি ছেলে গোয়াতে এসে হঠাৎ জম্বি-দের কবলে পড়েছিল।
জম্বি অর্থাৎ জীবন্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ানো মৃতদেহ। যারা মানুষের রক্ত খায়। অদ্ভুত দেখতে সব মৃতদেহ। মুখ বেয়ে শুধু রক্ত ঝরে।
গা শিউরে ওঠে সেই কথা ভেবে।
তবে ও সব তো কল্পনা। বাস্তবে কি আর জম্বি থাকে নাকি?
গুটিগুটি পায়ে এগোতে থাকি। চারিদিকে শুধু একটা নোটিস বারবার চোখে পড়ছে। ‘নো ড্রাগস’।
বার কাউন্টারে অবশ্যই ভিড় বেশি। হঠাৎ এক মহিলা পাওলিকে টেনে নিয়ে যান। “আমি আর্মেনিয়ান,” বলে কী সব নিজের ভাষায় বলতে থাকেন। হাতে পানীয়। নেশার ঘোরে চুর। শুধু একটা কথা বোঝা গেল। “আপনি খুব সুন্দরী। ছবি তুলতেই হবে আপনার সঙ্গে,” বলে ক্যামেরা বের করে পাওলির সঙ্গে ছবি তোলার কী হিড়িক!
ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধের লাগল না। ‘এক্সকিউজ আস’ বলে অন্য দিকে চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বাঁ দিকে পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছোট একটা বাড়ি। ওখানেই আসল ডিস্ক। ভিতরে ঢুকতেই একটা অদ্ভুত পরিবেশ। শুধু স্ট্রব লাইটস। আর কালো দেওয়ালে প্রচুর তারা বসানো আছে। মধ্যে মধ্যে রয়েছে কিছু থাম। তার গায়ে লাগানো আয়না। অনেক ডিস্কেই আগে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু এই জায়গাটা একদম অদ্ভুত! যে দিকে তাকাবেন, শুধু কিছু তারা। আর কাচের মধ্যে দেখা যাবে কিছু দাঁত আর ভূতের মতো চোখ জ্বলজ্বল করছে। নাচের তালে তালে নড়তে থাকে সেগুলো। হঠাৎ দেখে ভয় পেয়ে যাওয়াটা আশ্চর্য নয়।
‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-য়ের কোনও সিকোয়েল হলে এ রকম জায়গায় শুট্যিং করলে মন্দ হবে না।
ডান দিকে একটা ছোট অ্যান্টি চেম্বার। জায়গাটা লাল ভেলভেটের পর্দা দিয়ে মোড়া। পাশে একটা ছোট আর্মচেয়ার। হঠাৎ ডিস্কে আর্মচেয়ার কেন রাখা থাকবে এটার রহস্য ভেদ করার আগে চোখ চলে গেল একটা সিঁড়ির দিকে। দোতলায় উঠে যাচ্ছে। চার পাশে জানালা। কিন্তু সে জানলাগুলো একটাও খোলে না। কোনায় দাঁড়িয়ে নীচ থেকে ডান্স ফ্লোরটা দেখতে অদ্ভুত লাগে। ‘ভূতেদের গান’ জানা ছিল। এই প্রথম মনে হল ভূতেদের নাচও দেখা যায়। একটা ছোট স্টেজ করা ছিল মাঝখানে। তার পাশে একটা বোর্ড। তাতে লেখা: ‘ওনলি লেডিজ’!
হঠাৎ ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল। দেওয়াল ভেদ করে বেরিয়ে এলেন একজন।
ওই রকম ছোট জায়গায় যে একটা লুকনো দরজা থাকতে পারে, সেটা চিন্তাতেই আসে না। পাওলি ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করেন, “এই রকম একটা দেওয়ালের মধ্যে লুকনো দরজা...ওখানে কী করছিল লোকটা?”
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কেউ ছিলেন না।
এই ঘটনার সাক্ষী বলতে কিছু নির্বাক বিজ্ঞপ্তি। তাতে লেখা ‘নো ড্রাগস’!
তাড়াতাড়ি নীচে চলে আসা হল।
রাত তখন প্রায় দেড়টার কাছাকাছি।
ফেরার পথে পাওলি বলেন, “এ একদম এক অন্য রকমের গোয়া। এই গোয়ার সঙ্গে আমি যে কোঙ্কনি সিনেমাটা করেছি, তার কোনও মিলই নেই... তবে সে গোয়ার ছবিটাও কিন্তু মনে রাখার মতো। সে ছবিতে আমার চরিত্রের নাম শোভা। পুঁতির মালা বিক্রি করে বিচে। ইফিতে আপনি আমার সিনেমা ‘বাগা বিচ’-এর প্রথম দিনের স্ক্রিনিংটা দেখলেই বুঝতে পারবেন আমি কী বলতে চাইছি...”
দু’দিন পর ‘বাগা বিচ’-এর স্ক্রিনিং ছিল ইফিতে। প্রচুর ভিড়। গোয়ান দর্শকের উৎসাহের শেষ নেই সিনেমাটা নিয়ে। কারণ এই প্রথম গোয়ান পরিচালক গোয়ার এমন কিছু ছবি তুলে ধরেছেন যা আগে কেউ দেখেনি।
বিদেশিরা গোয়া বিচে এসে শিশুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তা সিনেমাতে দেখানো হয়েছে। বাচ্চারা তার থেকে রোজগার করে ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এইচআইভি-রও শিকার হয়ে পড়ে।
অঞ্জুনা বিচের ফ্লি মার্কেটে পরে বাস্তব পরিস্থিতিটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে দেখেছি এই ধরনের প্রচুর মেয়ে সত্যি সত্যিই গোয়াতে পসরা সাজিয়ে বসেন। বিক্রি করেন সুগন্ধি চা-পাতা থেকে শুরু করে স্কার্ফও। কিন্তু গরগর করে ফ্রেঞ্চ আর রাশিয়ান বলে চলেন। কেউ কেউ বিদেশি খদ্দের দেখে একটু দুষ্টু হেসে চোখ মেরে কথা বলেন। কেউ আবার একদম রিজার্ভড!
এই গোয়া কিন্তু ফেনি, ফান আর ফ্রিডম-এর দুনিয়া থেকে অনেকটাই দূরে। এরা খানিকটা প্রান্তিক। কিন্তু এরা ছাড়া গোয়ার ছবিটা অসম্পূর্ণ। “আসলে আমি বাস্তব আর সিনেমার পর্দায় দু’টো দু’ধরনের গোয়াকে দেখলাম। এই ক্লাব কাবানার গোয়াটা একদম অন্য একটা জগৎ। আর ‘বাগা বিচ’-এর গোয়াটা একদম উল্টো মেরুর।
গোয়াতে বসে গোয়ান পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সতগাঁওকর এই ধরনের একটা সিনেমা বানাতে ভয় পেলেন না? আপনার মতো এক বাঙালি অভিনেত্রীকে এক পুঁতি বিক্রেতার চরিত্রে কাস্ট করলেন! বিহারি অভিনেতা আকাশ সিংহ-কে (‘গ্যাংস অব ওয়াসেপুর’, ‘লাঞ্চবক্স’, ‘শহিদ’ সিনেমার অভিনেতা) নিলেন কর্নাটক থেকে আসা একজন মাইগ্র্যান্টের চরিত্রে? “ছবিটা সেন্সর হয়েছে। কিন্তু ব্যান-কে আমি ভয় পাই না। সত্যিটা তুলে ধরতেই হবে,” উত্তর পরিচালকের।
পাওলি অবশ্য বিতর্কিত কিছু নিয়ে কথা বলতে নারাজ। গোয়া থেকে মুম্বই চলে যাওয়ার তাড়াতে এ বার আর বাগা বিচ-য়ে ঘুরে আসা হয়নি।
তবে নিজে বাগা বিচে গিয়ে দেখলাম যে ব্রিডো’স স্যাকের বাইরে বাস্তবের শোভারা দাঁড়িয়ে। “ম্যাডাম, হার চাহিয়ে? বেস্ট ডিল...” মনে হল ‘বাগা বিচ’-য়ের সংলাপ শুনছি। প্রশ্ন করলাম তারা সিনেমাটার কথা জানে কি না। গল্পটা বললাম। সঙ্গে সঙ্গে এক ডজন শোভা কোথা থেকে এসে যেন উপস্থিত হল! “হ্যাঁ, আমাদের পুলিশ তাড়া করে তো। খুব অসুবিধে হয়। এই নিয়ে সিনেমা হয়েছে? কে? পাওলি? উসনে ‘হেট স্টোরি’ বোলকে কুছ পিকচার কিয়া থা না?”
কোথায় যেন বাস্তব আর পর্দা মিলে গেল। মনে হল গোয়ার ছবিটা এ বার সম্পূর্ণ হল।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.