জেলাশাসক পাকড়াও, শাস্তির মুখে পুলিশকর্তা
দুর্নীতির অভিযোগে মালদহের জেলাশাসক গোদালা কিরণকুমারকে শনিবার গ্রেফতার করল শিলিগুড়ি পুলিশ। এ দিনই আদালতে পেশ করা হলে তাঁকে চার দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। কর্তব্যরত কোনও জেলাশাসককেগ্রেফতার করারঘটনা এ রাজ্যে এই প্রথম। যা নিয়ে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়েছে প্রশাসনের অন্দরে। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার কে জয়রামন তাঁর এক্তিয়ারের সীমা ছাড়িয়েছেন বলে মন্তব্য করে এ দিন বিকেলেই মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র জানিয়ে দেন, ওই পুলিশকর্তাকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নবান্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, কিরণকুমারকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এই খবর চাউর হতেই আইএএস মহলে তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। তাঁরা একে অপরকে ফোন করে সবিস্তার ঘটনা জানার চেষ্টা করেন। সচিবদের একাংশ বলেন, দুর্নীতির মামলায় মালদহের জেলাশাসকের বিরুদ্ধে যে তদন্ত চলছে, তা নিয়ে তাঁদের বলার কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে আইন আইনের পথে চলবে। কিন্তু যে ভাবে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা কোনও ভাবেই কাম্য নয়। মুখ্যসচিবও তাঁর সাংবাদিক বৈঠক বলেন, “আমরা মনে করি, যখন অভিযুক্তের পালিয়ে যাওয়ার, সাক্ষীদের প্রভাবিত করার বা সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাটের আশঙ্কা থাকে, তখনই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু গোদালা কিরণকুমারের ক্ষেত্রে এর কোনওটাই প্রযোজ্য নয়।
শিলিগুড়ির আদালতে মালদহের জেলাশাসক গোদালা কিরণকুমার। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
সাধারণ ভাবে কোনও পদস্থ আধিকারিকের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার আগে রাজ্য সরকারের অনুমতি নেওয়া বা তাকে জানানো প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কোনওটাই করা হয়নি।”
এ দিন বেলা ৩টে নাগাদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ঢোকেন মুখ্যসচিব-সহ ছ’জন সচিব। সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, উন্নয়ন সংক্রান্ত বৈঠকে যোগ দিতেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে গিয়েছিলেন সচিবেরা। খাতায়-কলমে কিরণকুমার তখনও গ্রেফতার না-হলেও তাঁকে ঘিরে তৎপরতার খবর যে তত ক্ষণে নবান্নে এসে গিয়েছে, সে কথা জানাচ্ছেন সচিবদেরই একাংশ। বিকেল চারটে নাগাদ গ্রেফতার হন মালদহের ডিএম। সওয়া ৪টে নাগাদ ডিজি জি এম পি রেড্ডির ডাক পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে যান ডিজি। মিনিট পনেরো পরেই বেরিয়ে আসেন তিনি। তার এক ঘণ্টার মধ্যেই সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন মুখ্যসচিব। জানিয়ে দেন জয়রামনের অপসারণের খবর।
“পুলিশ কমিশনারের যা করার কথা ছিল, তার থেকে তিনি বেশি কিছু করেছেন,” মুখ্যসচিব এ কথা বললেও রাজ্যের একাধিক পুলিশ-কর্তার দাবি, কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্মসচিব কিংবা তার চেয়ে উঁচু পদের অফিসারকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। সেই নিয়ম রাজ্যের ক্ষেত্রে খাটে না। ‘কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর’-এর সংশোধিত ৪১ নম্বর ধারা উল্লেখ করে (যে ধারায় গ্রেফতার করা হয়) তাঁদের বক্তব্য, তদন্তকারী সংস্থা যদি মনে করে অভিযুক্ত কোনও ভাবে তদন্তকে প্রভাবিত করছেন এবং সে ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ পুলিশের হাতে আছে, তা হলে তাঁকে গ্রেফতার করার আগে সরকারের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। অনুমতি নিতে হয় চার্জশিট পেশের আগে।
ওই পুলিশ-কর্তারা আরও বলছেন, লোকসভা বা বিধানসভার সদস্যদের গ্রেফতার করার আগেও স্পিকারের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। গ্রেফতার করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে জানাতে হয় মাত্র। অতএব কিরণকুমারকে গ্রেফতার করে জয়রামন আইনগত দিক থেকে কোনও অন্যায় করেননি বলেই তাঁদের দাবি।
নবান্ন সূত্রের খবর, কিরণকুমার যখন শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) সিইও ছিলেন, তখন বিভিন্ন কাজে ৬০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই মামলায় কিরণকুমারকে গ্রেফতারের অনুমতি চেয়ে গত জুলাইয়ে রাজ্যকে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন জয়রামন। দিন পনেরো আগে ফের একই আর্জি জানান তিনি। তখনই জয়রামনকে বলা হয়, তিনি যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট পেশ করেন। তার পরেই সরকার পদক্ষেপ করবে।

তখন নবান্নে
৩টে: মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে উন্নয়ন নিয়ে মুখ্যসচিব-সহ ৬ সচিবের বৈঠক
সাড়ে ৩টে: বৈঠকে যোগ দিলেন স্বরাষ্ট্রসচিবও
৪টে ৫: গোদালা গ্রেফতারের খবর এক অফিসারের মোবাইলে
৪টে ১২: তলব পেয়ে এলেন পুলিশের ডিজি জি এম পি রেড্ডি
সাড়ে ৪টে: মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের বৈঠক শেষ
৪টে ৪০: ছয় সচিব এলেন ১৩ তলায় মুখ্যসচিবের ঘরে
সওয়া ৫টা: প্রেস কর্নারে মুখ্যসচিবের সাংবাদিক সম্মেলন
দুর্নীতির ইতিবৃত্ত
মার্চ, ২০১৩: এসজেডিএ-র সিইও গোদালা কিরণকুমার মালদহের জেলাশাসক হলেন।
১৪ মার্চ: মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান পদ থেকে রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যকে সরিয়ে দায়িত্ব উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবকে। বিভাগীয় তদন্ত শুরু।
১৭ মে: এসজেডিএ দফতরে পুলিশি হানা।
৬ জুলাই: মালদহে গিয়ে পুলিশের জেরা গোদালাকে।
৩ অগস্ট: শিলিগুড়ি কমিশনারেটে ডেকে পাঠিয়ে দিনভর জেরা গোদালাকে।
৫- ৮ অগস্ট: রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য, এসজেডিএ-র তিন সদস্য তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জন শীলশর্মা, জলপাইগুড়ি জেলা তৃণমূল সভাপতি চন্দন ভৌমিক এবং কংগ্রেস বিধায়ক শঙ্কর মালাকারকে জেরা। গোদালাকে গ্রেফতার করার অনুমতি চেয়ে ডিজির কাছে আবেদন জয়রামনের।
২৩ অক্টোবর: ডিজি এবং মুখ্যসচিব গোদালার বিরুদ্ধে অভিযোগ সংক্রান্ত রিপোর্ট চান।
২৭ অক্টোবর: জেরায় ডাকলে অসুস্থ বলে গেলেন না ডিএম। ডিজি-কে রিপোর্ট কমিশনারের।
২৯ নভেম্বর: শিলিগুড়ি থানায় ডিএম-কে টানা ৭ ঘণ্টা জেরা।
৩০ নভেম্বর, ২০১৩: গোদালা কিরণকুমার গ্রেফতার।
এসজেডিএ-তে দুর্নীতি
তিনটি শ্মশানে কাজ না করে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ।
মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানে কাজ না করে প্রায় ১৭ কোটি খরচ।
টেন্ডার ছাড়া জোড়াপানি নদী সংস্কারে প্রায় ৯ কোটি ব্যয়।
শিলিগুড়ি শহরে সিসিটিভি বসানোয় প্রায় ৮ কোটির অনিয়ম।
যে ধারায় মামলা (ভারতীয় দণ্ডবিধি)
অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র (১২০ বি) সরকারি কর্মী হিসেবে বিশ্বাসভঙ্গ (৪০৯) প্রতারণা (৪২০) ভুয়ো নথি তৈরি (৪৬৭) প্রতারণার জন্য ভুয়ো নথি তৈরি (৪৬৮) জাল নথি বা বৈদ্যুতিন তথ্য আসল বলে চালানো (৪৭১) হিসেবে কারচুপি (৪৭৭ এ) ইত্যাদি।
নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, চার্জশিট পেশের পরে গোদালাকে জেলাশাসকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন কোনও পদে বদলি করা হবে। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও শুরু হবে। এক জন কর্তব্যরত জেলাশাসককে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করলে অফিসার মহলে ভুল বার্তা যাবে, সেই কারণেই ওই পথ বাছা হয়েছিল বলে নবান্ন সূত্রের খবর। সে কথা জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল জয়রামনকে।
এ দিন গোদালাকে গ্রেফতার করা হল কেন? সরকারের পরামর্শ মেনে তদন্তের জাল গুটিয়ে আনেননি জয়রামন। সেই সূত্রেই শুক্রবার গোদালাকে কমিশনারেটে সাত ঘণ্টা জেরা করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগে তিন ঘণ্টা অফিসারদের ঘরে ছিলেন কিরণকুমার। তদন্তকারীদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার বদলে কেন তাঁকে বারবার জেরা করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে কৈফিয়ত চাইতে থাকেন গোদালা। এমনকী, ক্ষমতা থাকলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে দেখাক, পুলিশ কমিশনারকে এমন কথাও শুনতে হয় বলে অভিযোগ। পুলিশ-কর্তাদের একাংশ বলছেন, সে কথা সহ্য করতে না পেরেই এক রকম রাগের মাথায় কিরণকুমারকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন জয়রামন।
মুখ্যসচিব অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন, পুলিশ যে জেলাশাসককে শুক্রবার থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, সরকার তা জানত না। কিরণকুমারকে গ্রেফতার করার আগে ডিজি-কেও কিছু জানানো হয়নি বলে তাঁর দাবি।
মুখ্যসচিবকে প্রশ্ন করা হয়, জেলাশাসককে গ্রেফতার করার আগে পুলিশ যদি সরকারকে জানাত, তা হলে কি প্রশাসনের তরফে পদ্ধতিগত কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল? সঞ্জয়বাবু বলেন, “জানতে পারলে কী কারণে পুলিশ গ্রেফতার করতে চাইছে, তা দেখা যেত। এ রকম দুমদাম কিছু না-ও হতে পারত।”
জয়রামনের কাজ যে সরকার কোনও মতেই বরদাস্ত করছে না, তা বুঝিয়ে দিয়ে মুখ্যসচিব জানান, শিলিগুড়ির সিপি-কে দায়িত্ব ছেড়ে কলকাতায় আসতে বলা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সঞ্জয়বাবুর কথায়, “দিস ইজ হাইলি এমব্যারাসিং (ঘটনাটা খুবই অস্বস্তিকর)। এটা করার দরকার ছিল না।” এ দিনই উত্তরবঙ্গের আইজি শশীকান্ত পূজারীকে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। মুখ্যসচিব জানান, পরে সম্ভবত জাভেদ শামিমকে (বর্তমানে তিনি জলপাইগুড়ি রেঞ্জের স্পেশাল আইজি) ওই পদে পাঠানো হবে।
মালদহের জেলাশাসক কে হবেন, তা জানাতে পারেননি মুখ্যসচিব। বলেন, “মালদহে ভোট প্রক্রিয়ার (ভোটার তালিকা সংশোধন) কাজ চলছে। তাই কমিশনের অনুমতি ছাড়া কাউকে বসানো যাবে না।
নামের তালিকা পাঠাব। কমিশনই জেলাশাসক বাছবেন।” ওই প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত মালদহেরই এক জন অতিরিক্ত জেলাশাসককে ওই দায়িত্ব সামলাবেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যসচিব।

পুরনো খবর:





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.