প্রবন্ধ ১...
একটা অভয়ারণ্য দেবেন?
ব্যস। মিলে গেল মেয়েদের সুরক্ষার আরও একখান সমাধান সূত্র। কেরলে চালু হল মেয়েদের জন্য ট্যাক্সি। কেরল সরকার একটি সংস্থা তৈরি করে দিয়েছে, তার নাম ‘জেন্ডার পার্ক’। তারাই বাজারে নিয়ে এল ‘শি ট্যাক্সি’। মেয়েরাই মালিক, মেয়েরাই চালাবে, মেয়েরাই চড়বে। রাতবিরেতে বাড়ি ফেরার সময় লিফট দেওয়ার নামে কোট-টাই পরা সহকর্মীর, বাসস্ট্যান্ডে বাইক চড়া লোফারের কিংবা ফাঁকা রাস্তায় নিরীহদর্শন ট্যাক্সি ড্রাইভারের কনুই, বুকে হাত, শরীরে চড়াও কিংবা ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই মিলবে। সবাই শি ট্যাক্সি চড়তে পারবে না, ঠিক, কিন্তু যারা পারবে তারা তো বাঁচবে। কেরল সরকারকে কুর্নিশ।
মেয়েরা বাইরে বেরোলে কখন কোথায় কে কবে কেমন হিংসার মুখোমুখি হবে কেউ জানে না, ইকোয়েশনটা তো সে রকমই দাঁড়িয়েছে। জীবন অনিত্য, নিরাপত্তা মেয়েদের কাছে তেমনই অনিত্য। অথচ, বলুন তো, সারা দিন খাটনির পর কানে মোবাইল গুঁজে আমাদেরও কি কিশোরকুমার শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না? কিন্তু তখন আমাদের ইজ্জত রক্ষার ফিকির খুঁজতে হয়। বাস না পেলে, ট্যাক্সি না পেলে, কিংবা পেলেও, পেটের ভেতর গুড়গুড় করে। বাস স্ট্যান্ডের ওই লোকটা কেমন করে যেন আমায় দেখছে। আচ্ছা, এখন তো ভরদুপুর, এখনও কি এই শুনশান রাস্তায় কেউ বাইকে চড়ে এসে ধর্ষণ করে দিয়ে যেতে পারে? কেউ সাহায্য করবে না?
নিশ্চয়ই করবে। পুরুষজাতের ওপর আমার অগাধ আস্থা। তাঁরা নিশ্চয়ই আমাদের রক্ষা করবেন। তাঁরা গন্যিমান্যি ব্যক্তি। তাঁরা যা করেন, যা বলেন, তা তো আমাদের ভাল’র জন্যই। এই যে তাঁরা বলেন, রাতবিরেতে ঘুরো না ফিরো না চাকরি করতে যেয়ো না জিনস-টি শার্ট পরে পুরুষকে খামখা তার বৃহত্তর কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্যুত করে উত্তেজিত কোরো না, হাবিজাবি ক’টা কাজ করে পুরুষের সমান হতে চেয়ো না এ সব তো আমাদের সার্বিক ভাল থাকার কথা ভেবেই বলেন। কিন্তু মেয়েরা সত্যি এমন বেয়াড়া হয়েছে যে ভাল কথা মোটে কানে নেবে না। নিজের গণ্ডির বাইরে গিয়ে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইবে। তা হলে তো পুরুষের দোষ নেই। তা হলে তো তাকে শিক্ষা দিতেই হয়, রেপ করতেই হয়।
ধর্ষিতা হওয়ার চেয়ে বাবা বাড়িতে থাকা ভাল। আমায় কেউ যদি বলে, ঘোমটা টেনে কি বোরখা পরে থাকো, নচেৎ ইজ্জত লুট হয়ে যাবে, আমি তো বাবা তাই করব। ইজ্জতের চেয়ে তো আর পোশাক বড় কথা নয়। আর ধর্ষণ মানে তো শুধু যৌনক্রিয়া নয়, বাবা গো, বড্ড লাগে যে! এক তো যৌনাঙ্গে লাগে, তার ওপর মার গলায় ফাঁস দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়, রড ঢুকিয়ে পাকস্থলী বের করে আনে, পা চিরে শরীর দু’ভাগ করে ঝোপে ফেলে দিয়ে যায়। কী শরীরের যন্ত্রণা, বলুন তো? হাত মচকে দেয়, ঠোঁট খুবলে নেয়, চোখ উপড়ে নেয়, মুখটা এমন ভাবে চেপে ধরে যে চোয়ালের হাড়গোড় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, তার পর মেরে ফেলে। আচ্ছা, আমি কি ওদের যৌনতায় আর হিংসায় তা দেব বলে জন্মেছিলাম? আমার কি পাঁঠার মাংস খেয়ে, আমির খানের সিনেমা দেখে জীবন বিতানোর অধিকার নেই? তাই বলি, এ সব পোহানোর চেয়ে ঢের ভাল নয় কি ভদ্র-সভ্য পোশাক পরে বাড়িতে বসে সিরিয়াল দেখা? মেয়েরা যখন বাইরে বেরোয়নি, কাজ করেনি, তখন কি বাপু দুনিয়া চলেনি? বড় জেঠিমাও তো বলতেন, ‘মেয়েছেলে হয়ে ড্যাংড্যাং করে অফিস যাওয়া কেন বাছা। বাপ-ভাইয়ে কি খেতে দিচ্ছে না?’
অথচ, ইতিহাস সাক্ষী, সেই কোন যুগে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ায়, মেয়েদের ঘরের বাইরে এনে আলোকপ্রাপ্তা করায় কাদের যেন হাত ছিল? রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বেথুন সাহেব তাঁরাও তো পুরুষ। নিরন্তর লড়াই চালিয়ে মেয়েদের অবস্থান পরিবর্তন করতে ওঁরাই তো পেরেছিলেন। মেয়েদের শিক্ষা দাও, মেয়েদের অধিকার দাও, আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়েদের ‘মানুষ’ মনে করো এ সব তাঁদের জীবনব্রত ছিল! ছিল তো ছিল। ও কী? আপনি এখনও বোকার মতো বিদ্যাসাগর, রামমোহনকে অনুসরণ করছেন নাকি? চিন্তা করবেন না, মেনস্ট্রিম পুরুষবাহিনী অচিরেই আপনাকে বিপন্ন প্রজাতি বানিয়ে দেবে। সেই যুগপুরুষরা মেয়েদের বাইরে আনতে পেরেছিলেন, এখনকার ‘যুগপুরুষ’রাও পারবেন মেয়েদের ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে পরিপূর্ণ সুরক্ষা দিতে। তাঁদের হিসেবটা পরিষ্কার মেয়েদের প্রতি হিংসা যত বাড়বে, মেয়েরা তত গুটিয়ে যাবে। যত স্বাধীনচেতা, তত কটূক্তি, তত ঢিলছোড়া, তত মার, তত ধর্ষণ, তত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার তাড়া। কায়দা করে ভায়োলেন্স-এর খেলাটা লেলিয়ে দিয়ে মেয়েদের ঘরে ঢুকে খিল আঁটতে বাধ্য করা। এতে এ-ও প্রমাণিত হল যে, আমরা তো আর বলিনি যে তোমরা খাঁচায় ঢোকো। খেলাটা মোক্ষম। মেয়েরাই নিজেদের দোষে ভায়োলেন্স ডেকে আনে, মেয়েরাই নিজেদের জন্য সংরক্ষণ চেয়ে গণ্ডি কাটে। অতএব লক্ষ্মণ দেওর, বৃত্তটি সম্পূর্ণ করো। না করে উপায়ই বা কী! আদরের মেয়েকে, বোনকে যৌনহেনস্থার সম্ভাবনায় ঠেলে দেওয়ার চেয়ে, তাদের শারীরিক-মানসিক ক্ষতির চেয়ে কিছু বাপ-দাদা-ভাইয়ের তো মনে হবেই যে তার ফুটফুটে পরিটি নিরাপদ আশ্রয়ে থাকুক। আমার বাবা, আমার দাদাও হয়তো তা-ই বলবেন।
কিন্তু মেয়েরা কোথায় দাঁড়াল? হয় হিংসা নয় সুরক্ষা, দুইই তাদের ঘেরাটোপে আটকে দিল। কারণ যা-ই হোক না কেন, ফল তো এক দিকেই ধাইছে। মেয়েদের তো আর নিস্তার হল না। দুঃশাসনের মার আর লক্ষ্মণের গণ্ডি, দুইয়ের মাঝে পিষে গেল তাদের স্বাধীনতা, তাদের ইচ্ছে, তাদের আকাঙ্ক্ষা, তাদের মর্যাদা, তাদের সাহস, তাদের দুঃসাহস, তাদের স্বস্তি, তাদের মস্তি, তাদের আনন্দ, তাদের মুক্তি।
আর দেরি নেই। শিগগিরই মেয়েরা বিকেল পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরবে, পুরুষসঙ্গীকে বডিগার্ড করে যাতায়াত শুরু করবে। আফগানিস্তানে যেমন কোনও পুরুষ সঙ্গে না থাকলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বারণ, আমরাও সে রকম হয়ে যাব। স্কুল থেকে, কলেজ থেকে, চাকরি থেকে রেহাই নেব। সাদা মলমলে সুচসুতো দিয়ে ফুল তুলে লিখব, ‘তোমার চরণে আমার স্বর্গ’। নিস্তরঙ্গ জীবনের সোয়াদ পেতে আমাদের কোনও বানানো গ্রামে, মাটির কুটিরে গিয়ে থাকতে হবে না। স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে, তা হলে তা এখানেই, এখানেই, এখানেই। তাই বলি কী, লেডিস সিট, লেডিস ট্রাম, লোকাল ট্রেনে লেডিস কম্পার্টমেন্ট, শি ট্যাক্সি একটা একটা করে আর কত সংরক্ষণ করবেন, তার চেয়ে একটা সংরক্ষিত স্থান করে দিন না আমাদের। একটা সত্যিকারের জেন্ডার পার্ক। যেখানে বাইরে থেকে এসে পুরুষ সভ্যরা দেখভাল করে যাবেন, আমরা অবলীলায় বিচরণ করব। ধরিত্রীতে শান্তি বিরাজ করবে। গণ্ডি কেটে আর হবে না। অনেক মেয়ে তো। অভয়ারণ্য চাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.