দেখিতে দেখিতে ডিসেম্বর আসিয়া পড়িল। অথচ এই সেই দিনই জানুয়ারি বহিতেছিল না? তখন যাঁহারা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, এই বৎসরের প্রতিটি মুহূর্তকে নিঙাড়িয়া উশুল করিয়া লইতে হইবে, এই বার অন্তত জীবনকে ভরিয়া তুলিতে হইবে কর্মে শ্রমে পরিকল্পনায় প্রয়োগে, তাঁহারা কিঞ্চিৎ ঘাবড়াইয়া ফ্যালফ্যাল তাকাইতেছেন। ডায়েরিও কিনিয়াছিলেন, জগিং-এর নিমিত্ত দামি জুতাজোড়াও, তবে কখন তাঁহাদের ফাঁকি দিয়া বৎসরটিই ভাগিয়া পড়িল? ইহাতে সন্দেহই নাই যে পৃথিবী চক্রান্ত করিয়া তাহার আবর্তনের গতি বাড়াইয়া দিয়াছে, ক্যালেন্ডার কোম্পানিগুলিও একটি-আধটি তারিখ প্রতি মাসেই বিলক্ষণ বাদ দিতেছে। নহিলে, কৈশোর বা যৌবনে যে বৎসরকালটিকে ফেলিয়া ছড়াইয়া উপভোগ করা যাইত, শৈশবে যে বৎসরটি কিছুতেই যাইতে চাহে না বলিয়া ক্লাস ফাইভ হইতে সিক্সে উঠিতে অনন্ত বিলম্ব ঘটিত, প্রৌঢ়ত্বে আসিয়া তাহার টিকিটি ধরিতে না ধরিতেই ধাবমান মেট্রো রেলের ন্যায় সে সটকাইয়া পড়িতেছে কী রূপে? ডিসেম্বরের পয়লা আসিবার ঝামেলা আরও রহিয়াছে। ইহা তো শেষ নহে, শেষের শুরু মাত্র। বৎসরটি সম্পূর্ণ রূপে সমাপ্ত হইয়া গেলে নূতন ডায়েরি কিনিয়া নয়া রেজোলিউশন-রঞ্জিত জীবনের প্রতি ধাবমান হওয়া যাইত। কিন্তু এই বার, এই অবশিষ্ট এক মাস লইয়া হাসিব না কাঁদিব? আলস্যে অকর্মণ্যতায় যখন বৎসরটি ঘোলা জলে ভাসিয়াই গিয়াছে, তখন এই একত্রিশ দিনও কি সেই সর্বনাশের গতিজাড্যেই ঢালিয়া দিব? অথবা তাহা অপেক্ষা শ্রেয় হইবে এই সময়টিকে অন্তত পূর্ব-অঙ্গীকার অনুযায়ী যাপন করিবার প্রয়াস? না কি এইটিকে পরবর্তী বৎসরের এক প্রাক্-প্রস্তাবনা ধরিয়া লইয়া, ‘আগামী’র বাঁশরি শুনিতে এখন হইতেই কর্ণ টাটাইয়া, ভবিষ্যতের আত্মপুষ্পবিকাশের মহড়া শানাইব?
তারিখ দিয়া জীবনকে খোপ কাটিয়া ভাগ করিবার পদ্ধতি ও সেই অনুযায়ী উজ্জীবিত বা অবসন্ন হইবার অভ্যাস অতীব হাস্যকর। মানুষ তাহার জীবনকে শস্যময় করিয়া তুলিতে পারে নিষ্ঠা ও আত্মপ্রয়োগ দ্বারা, ডায়েরি দ্বারা নহে। যে মানুষ জড়িমা ত্যাগ করিয়া ভোরে উঠিয়া দৌড়াইতে যাইবে, সে সতেরো তারিখ হইতেও তাহা করিতে পারিবে, ছাব্বিশ তারিখ হইতেও, এই কাজের জন্য একটি জাজ্জ্বল্যমান পয়লা তারিখ প্রয়োজন হইবে না। আর যে মানুষটি পয়লার জন্য হাঁ করিয়া অপেক্ষায় থাকিবে, সে ক্যালেন্ডারকে অধিক মর্যাদা দিয়া ও নিজ ইচ্ছাশক্তিকে অপমান করিয়া এক অতিপরিচিত অপদার্থতার পথই খনন করিবে। কিন্তু, ভাবিয়া দেখিলে, এই তারিখপনার কিছু উপকার অবশ্যই রহিয়াছে। কেবল গ্রিটিংস কার্ড সংস্থার বাণিজ্য নহে, এই মনোভাবের ফলে মানুষের প্রসন্নতাও কিঞ্চিৎ রক্ষিত হয়। মানুষ কড়া আত্মসমীক্ষার দ্বারা নিজের দুর্বলতাগুলি সম্যক চিনিয়া লইলে এবং অযুত বার ব্যর্থ হইয়া পুনরায় ব্যর্থতারই সম্ভাবনা প্রবল বুঝিলে, হয়তো তাহার জ্ঞান বাড়িত, কিন্তু মুখে হাসি থাকিত না, হৃদয়ে গান থাকিত না। এই যে ৩৬৫ দিনের এক উদ্ভট চক্র তাহাকে বারংবার সমাপ্তি ও নবসূচনার আভাস আনিয়া দিতেছে, ইহাতে সে বুক বাঁধিয়া শুরু করিবার এক প্রথা পাইয়াছে, যাহা বলিতেছে: তুমি নূতন হইতে পারো। যতই অবাস্তব হউক, এই প্রতিশ্রুতির এক নিরাময়-ক্ষমতা রহিয়াছে। যেমন কিছু ‘প্লাসেবো’-ঔষধ রোগীকে আরোগ্যের বিশ্বাস ব্যতীত কিছুই দেয় না অথচ রোগী তাহা জানিলেও কিছু পরিমাণ সারিয়া উঠে, তেমনই, পঞ্চাশ বৎসরে যাহা আয়ত্ত হয় নাই অকস্মাৎ একান্নতম বৎসরের একটি নির্দিষ্ট তারিখের মহিমায় তাহা হস্তগত হইবে কী রূপে, সেই স্বাভাবিক প্রশ্নকে ঠেলিয়া, আশাদীপ্ত পুনর্জন্ম-তত্ত্ব মানুষকে সত্যই নূতন আত্মজোর প্রদান করে, বুক বাঁধিয়া ঝাঁপাইতে প্রণোদিত করে। মনুষ্য দুর্বল, তাহার অবলম্বন প্রয়োজন, হাস্যকর লাঠি দিয়াও যদি উত্থান সম্ভব হয়, সেই যষ্টি-অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে উদযাপন কর্তব্য। |