৭২ টাকা দিন, আড়াই লাখ ধর্মে সইবে না
নিজের রূপযৌবনের ডালি উপুড় করে মনমোহন শর্মাকে দিতে চায় রেণু। টাকা-পয়সা তো তুচ্ছ। কিন্তু মনমোহন তাঁর ‘পাঁচ রুপাইয়া বারা আনা’র দাবি ছাড়বে না।
‘চলতি কা নাম গাড়ি’ ছবিতে কিশোর কুমার-মধুবালার সেই গানের দৃশ্যই মনে করাচ্ছেন হাবরার বাণীপুরের দীপু। পড়ে পাওয়া আড়াই লক্ষ টাকা ফিরিয়ে দিয়ে তিনি চান শুধু পাওনা ৭২ টাকা!
কেন? নইলে যে ‘ধর্মে সইবে না’!
হাবরার রাস্তায় লটারির টিকিট বিক্রি করেন দীপু সিংহ। দিনে রোজগার মেরেকেটে শ’খানেক টাকা। তাতেই বৌ আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে মাগ্গিগণ্ডার বাজারে খুঁড়িয়ে সংসার চলে তাঁর। টিনের চাল দেওয়া ইটের ঘরে সম্পত্তি বলতে একখানা মোবাইল ফোন। সেটাও আবার ব্যবসাতেই লাগে। অনেকে ফোন করে লটারির টিকিট চেয়ে পাঠান।
বাড়িতে লটারির টিকিট বাছছেন দীপু সিংহ। ছবি: শান্তনু হালদার।
গত রবিবার এমনই একটা ফোন এসেছিল। বাণীপুরের মিষ্টি ব্যবসায়ী জয় সাহা জানতে চান, সিকিম রাজ্য লটারির ক’টা টিকিট পাওয়া যাবে? দীপু জানান ৩৬টার একটা গোছা আছে। জয় বলেন, পরে এসে টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাবেন। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। জয়ের দেখা নেই। ৭২ টাকার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থেকে শেষে দীপু নিজেই হাজির হন জয়ের দোকানে। কিন্তু কর্তা নেই! বাড়ি ফিরেও ছেলেকে দিয়ে ফের টিকিট ক’খানা পাঠিয়েছিলেন। পরের দিন নিজেও এক বার যান। কিন্তু কোনও বারই দেখা মেলেনি। টিকিট বিক্রি করাও হয়নি।
দীপু যখন সেই বিক্রি হয়েও না হওয়া টিকিটের গোছা হাতে মনমরা, ফের ফোন বেজে ওঠে। না জয় নয়, এ বার দিগু দত্ত। উত্তর ২৪ পরগনার হাবরাতেই নতুনবাজারে লটারির কারবার দিগুর। তাঁর থেকেই টিকিট এনে বিক্রি করেন দীপু। “টিকিটের পার্টগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়, দেখি। মনে হচ্ছে প্রাইজ লেগেছে” উত্তেজিত শোনায় দিগুর গলা। দীপু গিয়ে দেখেন, তাঁর হাতে থাকা ৩৬টা টিকিটের প্রত্যেকটায় ৭ হাজার টাকা করে পুরস্কার উঠেছে। দ্বিতীয় পুরস্কার। মানে সব মিলিয়ে আড়াই লক্ষ টাকারও বেশি।
হইহই শুরু হয়ে যায়। কেউ বলে মিষ্টি আন, কেউ বলে চা আনা। অত্যুৎসাহীদের কেউ কেউ রোগাসোগা চেহারার দীপুকে চ্যাংদোলা করে নাচানাচিও শুরু করে দেয়। দীপুরও মুখে হাসি। কিন্তু প্রাইজ লাগার উত্তেজনা ছিটেফোঁটাও নেই। লাফালাফি একটু ঠান্ডা হলে জামা-টামা ঠিক করে শান্ত ভাবেই বোমাটা ফাটান তিনি, “ও টিকিট তো জয় সাহার। ওই টাকা আমি ছোঁব না।”
বলে কী! এক মুহূর্ত সব স্তব্ধ।
তার পরেই ফের হইচই ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে দীপুদা?’ ‘তুই কি পাগল হলি দীপু?’ কেউ বুদ্ধি দেয়, ‘অন্য সিরিজের ৩৬টা টিকিট জয়কে দিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কিন্তু দীপুর ওই এক গোঁ “জয়বাবুর জন্যই টিকিটগুলো রেখেছিলাম। কাজেই প্রাইজও ওঁর। ওই টাকা নিলে আমার ধর্মে সইবে না।”
‘ধর্ম’ মানে কী, জিজ্ঞেস করলে দীপু হয়তো গুছিয়ে জবাব দিতে পারবেন না। পুথি বলে, যা মানুষকে ধারণ করে, তা-ই ধর্ম। শব্দকোষও বলে, ধর্ম মানে ‘লোকধারক’ যা কিছু ‘শ্রেয়’, ‘ন্যায়’, ‘নীতি’। দীপু অত পুথি পড়েননি, শব্দকোষও ঘাঁটেননি। কিন্তু ধর্মটা বোধ হয় তিনি নিজের অন্তর থেকেই বুঝেছেন।
ভিড়টা একটু পাতলা হতেই গুটিগুটি পায়ে জয়ের বাড়ি গিয়ে হাজির হন দীপু। গোছাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “এই হল আপনার টিকিট। অনেক টাকার প্রাইজ উঠেছে। এ বার আমায় ৭২ টাকা দিয়ে বিদেয় করুন”জয় সাহা নিজেও থতমত! “আরে, তুমি তো আমায় টিকিট বিক্রিই করোনি। প্রাইজ যখন লাগল, তখনও তো টিকিট তোমারই কাছে!” কিন্তু দীপুকে বোঝায় কার সাধ্যি। শেষমেশ টিকিট নিতেই হয় জয়কে। কিন্তু বাড়ি বয়ে লাখের প্রাইজ তুলে দিতে আসা এমন একটা লোককে তিনি খালি হাতেই ফেরান কী করে? ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে দীপুর মেয়ের বিয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বলেন “এটুকু তোমায় নিতেই হবে!” তা আর দীপু ফেরাতে পারেননি।
যে মেয়ের বিয়ের জন্য ওই টাকা, সেই পিয়া এখন বাণীপুর স্কুলে মোটে ক্লাস সিক্সে পড়ে। তার দাদা মানিক নাইনে। কয়েক বছর আগেও দমদমে রিকশা চালাতেন দীপু। তাঁর গিন্নি কাকলির কথায়, “কত লোক কত কিছু ফেলে যেত রিকশায়। ও খুঁজে-খুঁজে গিয়ে ফেরত দিত। এক বার এক জনের ১০ হাজার টাকা ফিরিয়ে দেওয়ায় তিনি কিছু বখশিস দিতে চেয়েছিলেন। শুনে তো ও রেগে কাঁই!”
কিন্তু এ বারের কাণ্ডটা যে শুনছে সে-ই তো ধন্য ধন্য করছে? বৃহস্পতিবার বাড়ির দাওয়ায় বসে ফ্যানাভাত খেতে খেতে নিরুত্তাপ গলায় দীপু বলেন, “কী আর করেছি? মানুষের যা ধর্ম, তা-ই করেছি।” তাঁর একটাই শখ। পরিচিত কেউ মারা গেলেই মড়া কাঁধে শ্মশানে ছোটা।
“শেষবেলায় বাঁশের বাড়ি মেরে মড়ার পা ভেঙে দিতে হয়। কেউ তো কিছু সঙ্গে নিয়ে যায় না। আর... আমাদের তো এমনিই দিব্যি চলে যাচ্ছে...” খানিক উদাসীন ভাবেই বলেন দীপু। ধরতাইটা ধরে নেন কাকলি “আমাদের কোনও অভাব নেই। আসলে ভগবান ওঁকে ছোট্ট একটা জিনিস দিয়ে পরীক্ষা করলেন। লোভ করা অধর্ম। কে জানে, হয়তো অনেক বড় কিছু হারাতে হত!”





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.