মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অভিনব কাজে উদ্যোগী হইয়াছেন। উদ্যোগটি কেবল সহৃদয়তা নয়, সাহসেরও প্রমাণ। যে যৌনকর্মীরা বৃদ্ধ হইয়াছেন, যাঁহারা কোনও প্রকার কাজ করিতে অক্ষম, কেহ কেহ ভিক্ষা করিয়া দিনযাপন করেন, তাঁহাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করিতে চাহিয়াছেন। দক্ষিণ কলিকাতায় একটি বাড়ি নির্দিষ্ট করা হইয়াছে এই কর্মহীন, সহায়হীন অসহায় মানুষগুলির বসবাসের জন্য। কিন্তু সূচনাপর্বেই বাধা আসিয়াছে। মধ্যবিত্ত এলাকাটির বাসিন্দারা অনেকে সমবেত হইয়া প্রতিবাদপত্র জমা করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে, লোকালয়ের মাঝখানে এই বৃদ্ধাদের পুনর্বাসন উচিত কাজ নহে। তাহাতে পাড়ার পরিবেশ নষ্ট হইতে পারে। বিশেষত বাড়িটিতে ‘অবাঞ্ছিত’ ব্যক্তিদের আনাগোনার সম্ভাবনা আছে, যাহা মানিয়া লওয়া যায় না। অতএব প্রতিবাদ।
এই প্রতিবাদ আশ্চর্য করে না। যৌনকর্মীরা সমাজের প্রান্তে বসবাস করেন। কেবল প্রতীকী অর্থে নয়, আক্ষরিক অর্থেও তাঁহাদের জীবন ও বৃত্তি যাপনের জন্য ‘ভদ্রপল্লি’র বাহিরে নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত হয়। সর্বকালে, সর্বদেশে তাহাই নিয়ম। সমাজনীতির প্রণেতারা বলিয়া গিয়াছেন, লোকালয়ের প্রান্তে গণিকালয় একটি সুস্থ সমাজের লক্ষণ! সমাজ যাহাকে ব্যাধি বলিয়া মনে করে, তাহাকে বাহিরে সরাইয়া রাখিয়া আপনাকে শুচি রাখিতে চাহে। প্রাক্তন যৌনকর্মীদের লোকালয়ে পুনর্বাসন দিলে সমাজের ‘শুচিতা’ নষ্ট হইবে, পরিবেশ নষ্ট হইবে, নৈতিকতা নষ্ট হইবে এমন আশংকা অস্বাভাবিক নহে। শুচিতা বা নৈতিকতা সম্পর্কে এই ধারণার মূলে রহিয়াছে পরিবারের স্থায়িত্ব ও ‘পবিত্রতা’ রক্ষার তাগিদ। লক্ষণীয়, পরিবার বা সমাজের এই কাঠামো অ-প্রাকৃতিক প্রকৃতি উহা তৈয়ারি করে নাই। যে নৈতিকতা নষ্ট হইবার ভয়ে প্রাক্তন যৌনকর্মীদের লোকালয়ে স্থান দেওয়ার প্রস্তাবে সামাজিক আপত্তি উঠিতেছে, তাহাও সমাজকাঠামো ধরিয়া রাখিবার জন্য মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের উপায়। সেই নিয়ন্ত্রণ বাষ্পীভূত হইলে ব্যক্তির উপর সমাজের কর্তৃত্ব বজায় থাকিবে না, ফলে কাঠামোটি বিপদে পড়িবে। সমাজকাঠামো অ-প্রাকৃতিক বলিয়াই নৈতিকতার শৃঙ্খলা তথা শৃঙ্খল আবশ্যক। অতএব প্রতিবাদ।
স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করা গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে সম্ভব নহে, উচিতও নহে। কিন্তু প্রতিবাদ উঠিয়াছে বলিয়াই যদি পুনর্বাসনের উদ্যোগটি বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইবে দুর্ভাগ্যজনক। সমাজ চিরকালই তাহার প্রচলিত নিয়ম ও রীতি ভাঙিয়া এবং নূতন নিয়ম ও রীতি গড়িয়াই অগ্রসর হইয়াছে। কী নৈতিক, কী নৈতিক নয়, তাহার ধারণাও এই ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়াই বিবর্তিত হইয়াছে। যে নৈতিকতার বোধ হইতে প্রতিবাদ উঠিতেছে, তাহাকে শাশ্বত বা তর্কাতীত বলিয়া মনে করিবার কোনও কারণ নাই। যাঁহারা প্রতিবাদ করিতেছেন, তাঁহাদের সহিত আলোচনার মাধ্যমে সেই ধারণাকে বিচার করা সম্ভব। জবরদস্তি কাম্য নয়, আবার আত্মসমর্পণও বিধেয় নয়। যথার্থ যুক্তিবিচারের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাইতে পারে। তাহাই নেতৃত্বের দায়। নেতা বা নেত্রী সমাজকে নেতৃত্ব দিবেন, দৃষ্টান্ত স্থাপন করিবেন, ইহাই প্রত্যাশিত। সমাজের নিয়ম বা ধারণা অ-প্রাকৃতিক বলিয়াই তাহা বদলানোর সুযোগ রহিয়াছে। গণতান্ত্রিক সুযোগ। |