বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি মডেল) প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। ‘পাইলট প্রকল্প’ হিসাবে বাছা হয়েছে মালদহের ভূতনি-দিয়ারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে। আগ্রহী বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ‘এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ চাওয়া হয়েছে অক্টোবরে। কিন্তু রাজ্যের এই সিদ্ধান্ত কতটা সঙ্গত সে প্রশ্ন উঠছে সরকারি চিকিৎসকদের একাংশ এবং সংশ্লিষ্ট মহল থেকে।
এর আগে ‘পিপিপি মডেল’-এ খাস কলকাতা শহর লাগোয়া একাধিক হাসপাতাল চালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। অভ্যন্তরীণ বাধা তো ছিলই, কোনও বেসরকারি সংস্থা হাসপাতাল পরিচালনায় আগ্রহও দেখায়নি। মাস দু’য়েক আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, কোচবিহার এবং নদিয়ার ধুবুলিয়ায় নতুন মেডিক্যাল কলেজের জন্য ‘পিপিপি মডেল’-এ ‘এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ চেয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর। তাতে ভাঙড় ছাড়া অন্য দু’টির জন্য কেউ আগ্রহ দেখায়নি। রাজ্য যে সব বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছিল, তারা জানিয়েছিল, কলকাতা থেকে দূরত্বের জন্যই তারা কোচবিহার বা ধুবুলিয়ায় যেতে আগ্রহী নয়। সেখানে ভূতনির চরের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় একই মডেলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে কেন, সে প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরে।
দফতর সূত্রের খবর, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হবে চার বছরের জন্য। বেসরকারি সহযোগীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভবন, আবাসন, জল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জমি, আসবাবপত্র, ওষুধ, যন্ত্রপাতি দেবে সরকার। বিদ্যুতের খরচ মেটাতে হবে ওই সংস্থাকে। সেই সঙ্গে তারা চিকিৎসক, নার্স ও যাবতীয় হাসপাতাল-কর্মী নিয়োগ করবে, বেতন দেবে ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করবে। এ জন্য প্রতি বছর তাদের নির্দিষ্ট টাকা অনুদান দেবে দফতর। এ ছাড়া, ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওই বেসরকারি সংস্থা যাবতীয় শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে। অন্য সরকারি হাসপাতালে পিপিপি মডেলে চলা ‘ডায়াগনস্টিক সেন্টার’-এ যে টাকা নেওয়া হয়, তাই এখানে নেওয়া হবে। তবে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা রোগী এই পরিষেবা পাবেন নিখরচায়।
স্বাস্থ্য দফতর ঠিক করেছে, পিপিপি মডেলে চলা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা দিতে হবে। থাকবে জেনারেল মেডিসিন, শিশু এবং স্ত্রীরোগ বিভাগের আউটডোর। অসুস্থ শিশুদের জন্য চালু করতে হবে ইমার্জেন্সি চিকিৎসা পরিষেবা। জরুরি পরিষেবা এবং প্রসবের জন্য থাকবে ন্যূনতম ছ’টি শয্যা। রোগীকে অন্যত্র ‘রেফার’ করার প্রয়োজন হলে, তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য থাকবে গাড়ি।
রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর দাবি, সরকারের উদ্দেশ্য গ্রামের গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা। দুর্গম-প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কিছুতেই সরকারি চিকিৎসকেরা যেতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে, অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হতে বসেছে। তাঁর কথায়, “চিকিৎসকের এই খরা কাটাতে বেসরকারি অংশীদারিত্ব সাহায্য করবে।”
ভূতনির চরের তিন দিকে গঙ্গা। এক দিকে ফুলহার নদী। সেখানকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভরসায় থাকেন লক্ষাধিক মানুষ। বছর দু’য়েক ধরে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাত্র এক জন চুক্তির চিকিৎসক রয়েছেন। তিনি দুপুরে কয়েক ঘণ্টা ‘আউটডোর’ চালিয়ে ফিরে যান। দক্ষিণ চণ্ডীপুর গ্রামের রিয়াজুল শেখ, অতুল মণ্ডল, নরেশ মণ্ডলরা বলেন, “রাতে ফুলহার পেরিয়ে ১৩ কিমি দূরে মানিকচক গ্রামীণ হাসপাতালে রোগী নিয়ে যেতে গিয়ে হিমসিম খেতে হয়।”
পিপিপি মডেল-এ স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু হলে নিশ্চয়ই এই ছবিটা বদলাবে? “অবশ্যই’, দাবি করছেন রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা। তাঁর বক্তব্য, প্রতি তিন এবং ছ’মাস অন্তর নজরদারি করা হবে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ‘হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রাক্তন সভাপতি তথা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চিকিৎসক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়, ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিসেস ডক্টর্স’-এর সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ চক্রবর্তীরা অবশ্য ভিন্ন মত। তাঁরা বলছেন, “প্রত্যন্ত অঞ্চল বলে সরকার ডাক্তার পাঠাতে পারছে না, সেখানে স্বাস্থ্য-কর্তারা নিয়মিত পরিস্থিতি দেখতে যাবেন! দাবিটাই হাস্যকর।”
আর জন-স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী পুণ্যব্রত গুনের কথায়, “সরকার কেন তার হাসপাতাল চালাতে পারবে না? এটা তো তার দায়িত্ব! কোন বেসরকারি সংস্থা লাভ ছাড়া ব্যবসা করবে?” সরকারি চিকিৎসকদের একাংশেরও প্রশ্ন, কেন শুধু গ্রামের জন্য আলাদা করে নিয়োগ করছে না সরকার। রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সত্যজিৎ চক্রবর্তীর ক্ষোভ, “সরকারি জায়গা থেকে নগদ মূল্য দিয়ে গরিবকে স্বাস্থ্য-পরিষেবা কিনতে বাধ্য হতে হবে।”
স্বাস্থ্য দফতরের স্পেশ্যাল সেক্রেটারি পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “সরকার পিপিপি মডেলে যাচ্ছে, কারণ সরকারের টাকা নেই। স্বাস্থ্য পরিষেবা পুরোটাই বেসরকারি হাতে গেলে চিকিৎসার জন্য যে খরচ করতে হত, পিপিপি মডেলে তার থেকে কম খরচ হবে।” |