বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের লিখিত প্রশ্ন বদলে দেওয়ার অভিযোগ তুলে বুধবার বিধানসভায় তুমুল বিক্ষোভ দেখালেন বাম বিধায়কেরা। তাঁদের চিৎকার-চেঁচামেচির জেরে সভার কাজকর্ম কার্যত লাটে ওঠে। পরে অবশ্য সূর্যবাবুকে তাঁর প্রশ্নটি পড়ার অনুমতি দেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রশ্নের জবাবও দেন রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। কিন্তু তার পরও হট্টগোল চলতে থাকায় প্রায় সওয়া ঘণ্টা পর স্পিকার অধিবেশনের প্রথম পর্ব শেষ করে দেন।
সূর্যবাবু জানান, প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নামে রাজারহাটের নামকরণ নিয়ে নগরোন্নয়ন মন্ত্রীকে করা একটি প্রশ্ন তিনি জমা দিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, “আমি যে প্রশ্ন জমা দিয়েছিলাম, তার সঙ্গে বিধানসভায় পেশ হওয়া প্রশ্নের বিস্তর ফারাক রয়েছে। আমার লিখিত প্রশ্ন আমাকে না জানিয়েই বদলে ফেলা হল! এটা কী করে সম্ভব?” জবাবে স্পিকার বলেন, “প্রশ্ন পরিমার্জন করা হতেই পারে। অনেক সময় বিধায়ক লিখিত ভাবে এমন কিছু জমা দেন, যা প্রশ্ন আকারে সাজাতে গিয়ে পরিমার্জন করার প্রয়োজন হয়।” স্পিকারের জবাবে অখুশি সূর্যবাবু এই নিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। তখন স্পিকার বলেন, “আপনার প্রশ্নের অর্থ বদলায়নি। ঠিক আছে, আপনি যে প্রশ্ন জমা দিয়েছিলেন, সেটাই করুন।” পরে অধিবেশন কক্ষের বাইরে সূর্যবাবু বলেন, “আমার প্রশ্ন নিয়ে কারচুপি হয়েছে। নির্লজ্জ সরকার সত্যকে অসত্য করতে চাইছে।”
প্রসঙ্গত, নিউটাউনের নাম জ্যোতি বসু নগর করা নিয়ে শাসক ও বিরোধী দলের মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাম আমলে নাম বদলের প্রস্তাব এনে পাশ করা বিল মঙ্গলবারই ফিরিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। নয়া বিলে নিউটাউন নাম রাখার কথা বলা হয়েছে। যা নিয়ে প্রতিবাদে সরব বামেরা।
আসলে জ্যোতিবাবুর নাম জড়িত থাকায় বামেদের কাছে বিষয়টি কার্যত প্রেস্টিজ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। রাজ্য সরকারের নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিধানসভায় এর আগে বার বার সরব হয়েছেন বামেরা। কখনও সভা বয়কট করেছেন, কখনও বিধানসভা চত্বরে ধর্নায় বসেছেন। এ দিন ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে তাঁরা যে ভাবে ‘ওয়েল’-এ নেমে, কার্যবিবরণীর নথি ছিঁড়ে, চিৎকার করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, নতুন সরকারের আমলে তার নজির নেই বলেই মত অনেকের। পরে এক জনসভায় সূর্যবাবু বলেন, “এত দিন স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে কারচুপির অভিযোগ শোনা গিয়েছে। এখন তো দেখছি বিরোধী দলের প্রশ্ন বদল করে দেওয়া হচ্ছে!”
সূর্যবাবুর মূল প্রশ্নটি কী ছিল?
বিরোধী দলনেতা জানান, তাঁর প্রশ্নটি ছিল, ‘বিগত সরকারের পক্ষ থেকে নবনির্মিত রাজারহাট-নিউটাউনকে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু-র নামে ‘জ্যোতি বসু নগর’ রূপে নামাঙ্কিত করার সিদ্ধান্তটি কি বর্তমানে বহাল রয়েছে? যদি না থাকে তার কারণ কী?’ কিন্তু এ দিন তাঁর নামে যে দু’টি প্রশ্ন পেশ করা হয়, তাতে বলা হয়েছে: ‘এটা কি সত্যি যে, রাজারহাট-নিউটাউনকে ‘জ্যোতি বসু নগর’ রূপে নামাঙ্কিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং সত্যি হলে, কবে নাগাদ তা বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা যায়?’ এই প্রশ্ন দেখেই ক্ষেপে যান সূর্যবাবু। তাঁকে বলতে শোনা যায়, গত সরকার ‘জ্যোতি বসু নগর’ হবে বলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই বক্তব্যটাই তো বদলে ফেলা হয়েছে!” এই প্রসঙ্গে লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “সাধারণত দেখতে হয় প্রশ্নের বিষয়টি অবমাননাকর, ব্যক্তিগত কুৎসা বা বিদ্বেষমূলক কি না। অনেক সময় ব্যাকরণগত সংশোধনের প্রয়োজন থাকে। কিন্তু ঘটনাটা পাল্টে যেতে পারে না।” এ দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “স্পিকার যা করেছেন, তা নিয়ে মন্তব্য করব না। তবে বিষয়টি আমার অস্বাভাবিক লাগছে।”
বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের মত, “প্রশ্ন সম্পাদনা করার পূর্ণ অধিকার আছে স্পিকারের। সংশ্লিষ্ট বিধায়ক এ নিয়ে বিধানসভায় অভিযোগ করতে পারেন। এর বেশি কিছু তাঁর বলার নেই।”
স্পিকারের সিদ্ধান্ত রীতিবিরুদ্ধ নয় দাবি করে পরিষদীয়মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা যখন বিরোধী ছিলাম, তখন অনেক প্রশ্নের ভাষা সম্পাদিত করে দেওয়া হতো।”
স্পিকার সূর্যবাবুকে তাঁর জমা দেওয়া প্রশ্নটি করার অনুমতি দেওয়ার পরেও বামেদের ক্ষোভ মেটেনি। সেই প্রশ্নের জবাবে ফিরহাদ বলেন, “এ রকম কোনও সিদ্ধান্ত বিধানসভায় গৃহীত হয়নি। বিজ্ঞপ্তি জারি হয় এবং তা বাতিল হয়ে যায়। জ্যোতিবাবুর নামে নগর হবে কি না, সেই সংক্রান্ত বিল পাশ হয়েছিল। তা রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হলে তিনি সম্মতি দেননি। ফলে পুরো বিষয়টি বাতিল হয়ে গিয়েছে।”
মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরেই উত্তেজিত সূর্যবাবু চিৎকার করে বলেন, “মন্ত্রী সভাকে বিপথে চালিত করছেন। আমরা গত কাল রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেছি। জিজ্ঞাসা করেছি। তিনিএই বিল নিয়ে কিছু জানেন না বলেছেন।” বুধবারই রাজারহাটে এক অনুষ্ঠানের পরে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন জ্যোতি বসু নগর নিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি কোনও নাম পরিবর্তনকে সমর্থন করি না।”
ফিরহাদের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে সূর্যবাবু বলেন, হিডকো প্রথমে রাজারহাট-নিউ টাউনকে জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিতের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তা নগরোন্নয়ন দফতরকে জানানো হয়। ‘ক্যাবিনেট মেমো’ করে তা মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। সূর্যবাবুর অভিযোগ, “সেই সিদ্ধান্ত বাতিল কী করে হল?”
স্পিকার তাঁকে শান্ত করতে বলেন, “ঠিক আছে। পরের প্রশ্ন করুন।” আরও চটেন সূর্যবাবু। বাম বিধায়কেরা ওয়েলে স্লোগান দিতে থাকেন।
স্পিকার বলেন, “এই আচরণ ঠিক নয়।” ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ ও মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক স্পিকারের দু’পাশে দাঁড়ান। তৃণমূলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় স্পিকারের সঙ্গে কথা বলে অন্যদের কাছে যেতে শুরু করেন। কংগ্রেস সভায় ছিল না। সিপিএম চেঁচামেচি চালানোয় সভা মুলতুবি রাখা হয়।
এই ঘটনা নিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে পার্থবাবু নিন্দা প্রস্তাব আনেন। বিরোধীশূন্য সভায় তা পাশ হয়। পরে সভার বাইরে পার্থবাবু বলেন, “পর পর নির্বাচনে হার দেখে বামেরা বিধানসভায় হইহল্লা করে অস্তিত্ব জিইয়ে রাখতে চাইছে। বিরোধী দলনেতার নেতৃত্বে ওঁরা কুরুচিপূর্ণ অভব্যতা করেছেন। আশা করব, ওঁদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।” |