আপনার বাড়িতে জলের ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে আসা ছেলেটাকে যদি কলকাতার কোনও মঞ্চে দাপিয়ে মূকাভিনয় করতে দেখেন কী রকম লাগবে? কিংবা, স্টেশন চত্বরে ঠাকুমার হাত ধরে দু’মুঠো ভাতের সন্ধানে বের হওয়া নোংরা পোশাকের যে খুদেকে আপনি রোজ দেখেন, সে যদি মঞ্চে কয়েক মূর্হুতের জন্য প্রতিবাদী কৃষক কন্যে হয়ে যায়?
গল্প নয়। সত্যি।
বাইশ বছরের বিষ্ণু রায় আগে মছলন্দপুর স্টেশনে ফুল বেচত। নিয়মিত আড্ডা দিত স্টেশনের আশপাশে। পেশাটা এখন বদলেছে। ফুলের বদলে সে এখন স্টেশন চত্বরে ইডলি-ধোসা বিক্রি করে। আর্থিক সমস্যার কারণে মাঝে বন্ধ হতে বসেছিল লেখাপড়া। ধাক্কা সামলে সে এখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বিষয় নাটক। বিষ্ণুর আর একটা পেশাও আছে। মূকাভিনয়। |
আট বছর বয়স থেকে চায়ের দোকানে কাজ করত রবি পাড়ুই। এখন বয়স কুড়ি। বাড়ি বাড়ি জলের ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করে। কিছু দিন আগেও নেশা করত নিয়মিত। নেশা এখনও করে। তবে তা মুকাভিনয়। আর্থিক সমস্যায় অবশ্য লেখাপড়াটা শেষ করতে পারেনি সে।
সীমা ঢালি ও বিশ্বজিৎ ঢালির বাবা-মা নেই। নেই কোনও বাড়ি। আপাতত ঠিকানা মছলন্দপুর স্টেশন চত্বরের একটি ক্লাবঘর। ঠাকুমা দিন রাত পরিশ্রম করে যা রোজগার করেন তাতেই চলে সংসার। সীমা পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে, বিশ্বজিৎ দ্বিতীয় শ্রেণিতে। দু’জনেই নিয়মিত মূকাভিনয় করে মঞ্চে।
বিষ্ণু, রবি, সীমা, বিশ্বজিতেই তালিকাটা শেষ নয়। গুনলে সংখ্যাটা একশো ছাড়াবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গুজরাট থেকে দিল্লি ভারতের প্রায় সব জায়গাতেই অনুষ্ঠান করেছে এরা। এক সময়ে অসামাজিক কাজে যুক্ত থাকা, কিংবা প্রতি মুহুর্তে জীবন যুদ্ধে লড়তে থাকা এক দল ছেলেমেয়ে এক অন্য যুদ্ধ লড়ছে উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরের এক চিলতে ঘরে। সমাজের তৈরি করে দেওয়া পরিচয়ের বাইরে আত্মপরিচিতি তৈরির যুদ্ধ।
শিয়ালদহ থেকে বনগাঁগামী যে কোনও ট্রেনে উঠে ঘণ্টা দুয়েকের পথ উজিয়ে মছলন্দপুর স্টেশনে নেমে ডানদিকে শুক্র ও রবি দুপুর থেকে রাত স্থানীয় ছানা দুগ্ধ সমিতির অফিসে দেখা মিলবে এঁদের। মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেলে সমস্যা নিয়েই ক্লাস হয় পাশের চাষের জমিতে। প্রশিক্ষক ধীরাজ হাওলাদার পেশায় মছলন্দপুর স্টেশনের পাশের সাইকেল গ্যারাজ চালান।
কোন জাদুবলে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন?
ধীরাজবাবুর কথায়, “আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ উপন্যাসটা পড়ি। পালানোর ভূত চাপে আমার মাথায়। বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলাম। তখন অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সমাজ ওদের খারাপ বললেও আমি তাঁদের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি দেখেছিলাম।” |
|
|
বিষ্ণু রায় ও রবি পাড়ুই। |
|
এক বছর পরে বাড়ি ফিরে আসেন ধীরাজবাবু। বাড়ি ফেরার কিছু দিন পর পাড়ার এক অনুষ্ঠানে মূকাভিনয় দেখতে গিয়ে ভাল লাগে তাঁর। ধীরাজবাবু বলেন, “মূকাভিনয় দেখার পর মনে হল কোনও কথা না বলেই জীবনের সব কথা বলার জন্য এর থেকে ভাল মাধ্যম হয় না। এরপরই মূকাভিনয় শিখতে শুরু করি।” ঠাকুরনগরের দীপক মিত্র ও মছলন্দপুরের স্বপন সরকারের কাছে মুকাভিনয়ের প্রাথমিক ক্লাস নেন তিনি। ১৯৯৬ সালে নিজের দল করেন। তার পরে যোগাযোগ হয় বিশ্ববিখ্যাত মূকাভিনয় শিল্পী যোগেশ দত্তের সঙ্গে।”
প্রথমে অবশ্য মোটেও সহজ ছিল না কাজটা। নব্বইয়ের শেষ কিংবা নতুন শতকের গোড়ায় মছলন্দপুর স্টেশন চত্বরে নিয়মিত দুষ্কৃতীদের আনাগোনা ছিল। এছাড়া যাঁরা দু’বেলা ভাল করে খেতে পায় না তাঁরা মুকাভিনয় শিখতে কেন আসবে? ছাত্রছাত্রী পেতে অন্য উপায় নেওয়া হয়। ধীরাজবাবুর মুকাভিনয় স্কুলের নাচের শিক্ষিকা অঞ্জনা বিশ্বাস জানান, প্রতি ক্লাসের শেষে এখানে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া হয় কেক, বিস্কুট, লজেন্স। তাঁর কথায়, “অনুষ্ঠানে গেলে ভাল টিফিনের লোভ দেখিয়েও প্রাথমিক ভাবে অনেককে নিয়ে আসা হয়েছে।” তাঁর সংযোজন, “উৎসবের মরসুমে আমাদের প্রায়ই দিনে দু’টো করে অনুষ্ঠান করতে হয়। এমনি সময়েও মাসের বেশির ভাগ দিন অনুষ্ঠান থাকে। কয়েক দিন আগে বেলুড় মঠে বিবেকান্দ প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠান করলাম আমরা। ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠান আছে যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমিতে।” শুধু মূকাভিনয় শেখানোই নয়, ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকের লেখাপড়ার দায়িত্বও নিয়েছেন ধীরাজবাবু। তাঁর ছাত্র বিষ্ণু রায়ের কথায়, “ধীরাজদা না থাকলে আমার লেখাপড়া তো কবেই শেষ হয়ে যেত।”
ধীরাজবাবুদের কাজকে সম্মান জানাতে স্থানীয় দু’টি বেসরকারি স্কুলে মূকাভিনয়কে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এখানে ধীরাজবাবু ছাড়াও তাঁর এমন অনেক ছাত্রছাত্রী মূকাভিনয়ের ক্লাস নেন যাঁদের অনেকেই আর্থিক সমস্যায় স্কুলের প্রথাগত লেখাপড়া শেষ করতে পারেনি। স্থানীয় বেসরকারি বিদ্যালয় প্রিমিয়ার অ্যাকাডেমি হল এরকমই একটি স্কুল। বিদ্যালয়ের কর্ণধার অরূপ দে বলেন, “আজকের প্রজন্মের শিশুরা বেশির ভাগই ছোট পরিবারে বড় হয়। তাদের মনোসংযোগে অভাব দেখা যায়। অনেকে খেলাধূলা করার সুযোগও পায় না। তাই মূকাভিনয়। কারণ মুকাভিনয় হল শিশুদের মনোসংযোগ বাড়ানোর মাধ্যম। এর মাধ্যমে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশও ঘটে।”
ধীরাজবাবুর কাজের প্রশংসা করে তাঁর গুরু তথা বিশ্ববিখ্যাত মূকাভিনয়শিল্পী যোগেশ দত্ত বলেন, “সমাজের সকল স্তরের মানুষের মুখে ভাষা দেওয়ার মাধ্যম হল মূকাভিনয়। ধীরাজ তো সেই কাজটাই করছে। মুকাভিনয় শিখিয়ে ও অনেকের মুখের ভাষাই বদলে দিয়েছে। ওঁর কাজের দৃষ্টিভঙ্গিই আলাদা।”
ধীরাজবাবুর বাড়িতে রয়েছে মা, ভাই, স্ত্রী, ও মেয়ে। এই চড়া দামের বাজারে চলে কী করে? এতক্ষণ সাবলীল ভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ধীরাজ হাওলাদার এ বার একটু থমকে যান। “সাইকেলের গ্যারাজ আছে। সেখান থেকেই চলে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন মরসুমে নানা জিনিসের দোকান দিই।”
“এত ছেলেমেয়েকে মূকাভিনয় শেখাচ্ছেন, এখন তো মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেও আপনার কাছে মূকাভিনয় শিখতে আসেন। মাইনে নেন না?” “নিই তো। প্রতি মাসে এক টাকা। দক্ষিণা ছাড়া আবার বিদ্যাশিক্ষা হয় না কি?”—জিভ কাটেন ধীরাজবাবু। |
ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক। |