ইরানের সহিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চিন, ব্রিটেন, জার্মানি ও ফ্রান্সের ছয় মাসের যে অন্তর্বর্তিকালীন চুক্তিটি জেনিভায় স্বাক্ষরিত হইল, ইজরায়েল তাহাকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। ইজরায়েলের শঙ্কা বুঝা যায়। যে দেশ সরকারি ভাবে ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্বই স্বীকার করিতে চায় না, তাহার কূটনৈতিক ‘স্বীকৃতি’ সেই রাষ্ট্রের মনে শঙ্কা জাগাইবেই। কিন্তু ‘ঐতিহাসিক’ বিশেষণটি এই চুক্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ প্রযোজ্য। এই বোঝাপড়া অনুযায়ী আগামী ছয় মাস ইরানের বিরুদ্ধে জারি হওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাগুলি আংশিক ভাবে শিথিল করা হইবে, যাহার ফলে ইরান তাহার আটক সম্পদের সাতশো কোটি ডলার হাতে পাইবে। বিনিময়ে পরমাণু জ্বালানি কেন্দ্রগুলিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা পাঁচ শতাংশের মধ্যেই ইরান সীমাবদ্ধ রাখিবে, যাহার অর্থ পরমাণু বোমা বানাইবার প্রয়াস হইতে নিরস্ত হইবে। ঐতিহাসিক বইকী।
ইরানে গত নির্বাচনের পর হইতেই এই ইতিহাসের প্রস্তুতি শুরু হইয়াছিল। নবনির্বাচিত ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি গত কিছু কাল যাবৎই ইরানের পরমাণু কেন্দ্রগুলিকে আন্তর্জাতিক নজরদারির সামনে উন্মুক্ত করার সদিচ্ছার কথা বলিতেছিলেন। তাঁহার বক্তব্যের পিছনে ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের অনুমোদনও ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলি এই সদিচ্ছার সুযোগ সদ্ব্যবহার করিয়া অকারণ রণোন্মত্ততা হইতে পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতি ও কূটনীতিকে সরাইয়া আনিতে সচেষ্ট হইয়াছে। তাহার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত গত তিন দশকেরও বেশি কাল যে অহিনকুল সম্পর্ক লালিত হইয়াছে, তাহাতে ইতি টানার আবশ্যকতাও উপলব্ধ হইয়াছে। মার্কিন অর্থসাহায্যে ইরান তাহার নিষেধাজ্ঞা-বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাইতে পারে। ইরাক ও আফগানিস্তানের পর পারস্য উপসাগর অঞ্চল হইতেও মার্কিন রণতরী ও নৌসেনা স্বদেশে ফিরিতে পারে। তাঁহার পূর্বসূরি জর্জ বুশ ইরাক ও সাদ্দাম হুসেনের ক্ষেত্রে যে মারাত্মক ভুল করিয়াছিলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা ইরানের ক্ষেত্রে তাহার পুনরাবৃত্তি চাহেন না। তাই ইজরায়েল অসন্তুষ্ট হইবে জানিয়াও, মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকান সেনেটর এবং ইজরায়েলি লবির বিরুদ্ধাচরণের ঝুঁকি লইয়াও তিনি মার্কিন বিদেশ নীতিতে পরিবর্তন ঘটাইতে উৎসুক।
এই সব কিছুর পিছনেই অবশ্য এত দিনের কঠোর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইরান বুশ-কথিত ‘শয়তানি অক্ষ’র সদস্য না হইতে পারে, কিন্তু পাকিস্তান, লিবিয়া কিংবা সিরিয়ার মতো তাহার পরমাণু উচ্চাভিলাষ যে যথেষ্টই ছিল এবং সম্ভব আছে, তাহাতে সংশয় নাই। রাষ্ট্রপুঞ্জের অবরোধ এবং শক্তিধরদের নিষেধাজ্ঞাই তাহাকে বাধ্য করিয়াছে সেই উচ্চাশায় লাগাম পরাইতে। যদি ছয় মাসের বন্দোবস্তটি শেষ পর্যন্ত স্থায়ী চুক্তির দিকে অগ্রসর হয়, তবে পশ্চিম এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্যে নূতন সমীকরণ রচিত হইবে। তাহা বুঝিয়াই সৌদি আরবের মতো রাষ্ট্রও সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানাইয়াছে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম তেল-উৎপাদক রাষ্ট্র ইরানের সহিত মার্কিন সম্পর্ক স্বাভাবিক হইলে ভারতের পক্ষে ইরানের তেল আমদানি এবং ইরান-পাকিস্তান-ভারত পাইপলাইনের নির্মাণও গতি পাইবে। দুই দেশের ইতিহাস-পরীক্ষিত সুসম্পর্কের পুনরুজ্জীবন যে উভয়কেই লাভবান করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। আফগানিস্তানে তালিবান মারফত পাক প্রভাব বৃদ্ধির একতরফা অভিযান সংযত করিতে ওয়াশিংটন এবং নয়াদিল্লি তখন তেহরানকেও পাশে পাইবে। চুক্তির পরিণতি নির্ভর করিতেছে তেহরানের তরফে চুক্তির শর্তাবলি পালন করার উপর। তবে বৃহৎ শক্তিগুলি এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের দায়ও বিস্তর। দুই পক্ষই কী ভাবে আপন আপন দায় পালন করে, তাহাই দেখিবার। |