ঠিক ছিল, রায় বেরোবে দুপুর দু’টোর পর।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা পিছিয়ে তা ঠেকে বিকেল সাড়ে চারটেয়। রায় শুনে ভিড়ে ঠাসা কোর্টেই কেঁদে ফেললেন নূপুর তলবার।
কান্না ভেজা মুহূর্ত অবশ্য নেহাতই ক্ষণিকের। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আদালত থেকে তাঁদের বার করে নিয়ে যায় পুলিশ। বাইরে অপেক্ষায় তখন পুলিশ ভ্যান। বিধ্বস্ত রাজেশ-নূপুরকে তাতে তুলে পুলিশের বিশাল বাহিনী রওনা হয়ে যায় দসনা জেলের উদ্দেশে। বাইরে তখন টিভি ক্যামেরার সামনে ‘বাইট’ দেওয়া নিয়ে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছেন আইনজীবীরা। চলছে চেয়ার ছোড়াছুড়িও।
দসনা জেল অবশ্য রাজেশদের কাছে নতুন নয়। আগেও দফায় দফায় দসনা জেলে দিন কাটিয়েছেন তলবার দম্পতি। তবে প্রতিবারই সন্দেহভাজন হিসাবে। শাস্তিপ্রাপ্ত হিসেবে এই প্রথম। জেলের ১১ নম্বর ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয় রাজেশকে। আর ১৩ নম্বর বরাদ্দ নূপুরের জন্য। বিকেল বেলা পৌঁছনোর পর কয়েদি নম্বরও দিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের।
কাল রাতটাও আলাদা কুঠুরিতেই কাটিয়েছিলেন এই চিকিৎসক দম্পতি। কাল থেকেই নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছিল গোটা জেল চত্বর। প্রথম রাত্তিরটা যদিও স্বস্তিতে কাটেনি কারওই। জেলের কর্তারা জানিয়েছেন, কাল সারা রাত কেঁদে ভাসিয়েছেন নূপুর। রাতের খাবার দেওয়া হলে ফেলে রাখেন দু’জনেই। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ হঠাৎই জেলের কর্মীদের ডেকে নূপুর জানান, শরীরটা বিশেষ ভাল ঠেকছে না তাঁর। সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকরা পরীক্ষা করেন তাঁকে। উচ্চ রক্তচাপ, বদহজম, চিন্তা সব মিলিয়ে তত ক্ষণে রীতিমতো কাবু তিনি। ওষুধপত্র দিয়ে, খাবার খাইয়ে, ঘুমোনোর কথা বলে বেরিয়ে আসেন ডাক্তাররা। স্ত্রী’র মতো অতটা বাড়াবাড়ি না হলেও রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল রাজেশেরও।
মেয়ে-জামাইয়ের খবর পাওয়া ইস্তক অসুস্থ নূপুরের বাবাও। ভর্তি করতে হয়েছিল হাসপাতালে। এক কালে কাজ করেছেন দেশের বায়ুসেনায়। ভেঙে পড়া গলায় বললেন, “সারা জীবন দেশের জন্য করে শেষে কি না এই প্রতিদান পেলাম! খুনের যন্ত্রণা তো ভোগ করছিই, তার উপর বিচারটুকুও মিলল না। নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে।” নাতনিকে হারানোর শোক, মেয়ের গায়ে খুনির তকমা, স্বামী হাসপাতালে লড়ছেন একের পর এক শোকের ধাক্কায় কম বিচলিত নন নূপুরের মা লতা চিটনিস। আজ কোর্ট থেকে বেরিয়ে কান্না চাপতে চাপতে কোনও রকমে বললেন, “আমাদের জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। আসল সত্যি জানার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি আমরা।”
একের পর এক চমক, সিবিআইয়ের নিজেদের তথ্যেই নানা অসঙ্গতি, সব মিলিয়ে চূড়ান্ত হতাশ তলবারদের প্রতিবেশী-আত্মীয়স্বজন সকলেই। তবু তাঁরা যে হাল ছাড়ছেন না, গত কালই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন তা। আজ তাঁদের আইনজীবী রেবেকা জন অভিযোগ করেন পুরোটাই আসলে আইনের অপব্যবহার। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেছে। রেবেকার কথায়, প্রমাণের অভাবে এক কালে যারা মামলায় দাঁড়ি টানতে চেয়েছিল, আজ তারাই আদালতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের জন্য সওয়াল করছে। তাঁর মক্কেলদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ফাঁসানো হয়েছে দাবি করে রেবেকা বলেন, সিবিআই গোটা বিষয়টাকে প্রায় ‘উইচ-হান্ট’-এর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।
“এক দল পাগলকে তদন্তভার দেওয়া হয়েছিল। ওরা নিজেরাই তো এক এক বার এক এক কথা বলছে” ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন আরুষির আত্মীয়া শ্রী পরাদকর। রাজেশ-নূপুর তলবারকে দোষী সাব্যস্ত করার পর কালই মুখ খুলেছিলেন আরুষির বন্ধু ফিজা ঝা। বলেছিলেন, “কাকু-কাকিমা এমন কাজ করতে পারে, আমি বিশ্বাস করি না।” আজ তদন্ত থেকে বিচার, পুরো প্রক্রিয়াটাকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন ওই তরুণী। তাঁর কথায়, “গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য প্রমাণ নিয়ে সিবিআই ছেলেখেলা করেছে। আর তার পর গোটা গল্পটা সাজিয়েছে নিজেরাই।” ফিজা জানান, এক কালে আরুষিদের বাড়িতে নিত্য যাতায়াত ছিল তাঁর। দেখেছেন বাবা-মায়ের কতটা আদরের ছিল তাঁদের এক মাত্র মেয়ে। “ভালবাসাটাকে অবিশ্বাস করব কী ভাবে,” ভেবে কূল পাচ্ছেন না ফিজা।
“আরুষির চোদ্দো বছরের জন্মদিনটা নিয়ে তখন আমাদের সে কী উৎসাহ! আমি কখন থেকে যাব তা-ও ঠিক করে ফেলেছিলাম। তার পর তো গলা কেটে খুন করে গেল ওকে” জানাচ্ছিলেন আর এক বান্ধবী রাজেশ্বরী সহায়। সেই শুরু, তার পর থেকে খবরের চ্যানেলে বিতর্কে, পুলিশের অভিযোগে আরও যে কত বার মরতে দেখলাম ওকে, আক্ষেপ ঝরে পড়ে ওই তরুণীর গলায়। আর কিছু নয়, বন্ধুর চরিত্র হনন অন্তত এই বার থামুক, একটাই প্রার্থনা তাঁর।
প্রতিবেশীদের মধ্যে দ্বিমতও অবশ্য রয়েছে। জলবায়ু বিহার আবাসনেরই বাসিন্দা কিশোর যেমন জানালেন, দেরিতে হলেও আরুষি-হেমরাজ বিচার পেল।
কিন্তু এখনও মন মানছে না অনেকেরই। জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, সঞ্জয় মঞ্জরেকর, সোহা আলি খানদের টুইটে তাই ফুটে বেরিয়েছে প্রশ্ন, মামলা তো শেষ হল, কিন্তু ধোঁয়াশা ঘুচল কি?
|