|
|
|
|
লড়াই এ বার ইলাহাবাদ হাইকোর্টে |
আরুষিকে খুনের শাস্তি বাবা-মায়ের যাবজ্জীবন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
ফাঁসি নয়, যাবজ্জীবন। আরুষি হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত রাজেশ ও নূপুর তলবারকে সর্বোচ্চ সাজা দিল না সিবিআই আদালত। যদিও তাতে তলবার পরিবার এবং আরুষির আত্মীয়-পরিজন-বন্ধুদের ক্ষোভ এতটুকু কমেনি। তাঁরা সকলেই দাবি করছেন তদন্তে মা-বাবাকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে। তারই প্রতিফলন ঘটল বিচারপ্রক্রিয়াতেও।
সাজা শুনে এ দিন আদালতের মধ্যেই ভেঙে পড়েন তলবার দম্পতি।
সিবিআই বিচারক গত কাল তাঁর রায় শুনিয়ে আরুষি হত্যার ঘটনাকে মানবজাতির ইতিহাসের বিচ্যুতি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আজ সাজা শোনানোর সময় অবশ্য তিনি একে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ঘটনা বলে গণ্য করেননি। যদিও সিবিআই আইনজীবী সেই সওয়ালই করেছিলেন। কোর্টের বাইরে বেরনোর পরে তাদের আইনজীবী আর কে সাইনিকে প্রশ্ন করা হয়, সিবিআই কি ফাঁসি চেয়েছিল? সাইনি বলেন, “ফাঁসি কি যাবজ্জীবন, সেটা কথা নয়। আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছিলাম। আদালত যা ঠিক মনে করেছে, সেটাই করেছে।” |
|
তখনও জানেন না কী সাজা হবে। মঙ্গলবার গাজিয়াবাদ আদালতে নূপুর তলবার। ছবি: পিটিআই। |
অপরাধীদের কী সাজা হবে, গাজিয়াবাদের আদালতে তার সওয়াল-জবাব আজ দুপুরে পাঁচ মিনিটেই শেষ হয়ে যায়। মূলত তিনটি বিষয়ে বিতর্ক হয়। সিবিআইয়ের যুক্তি ছিল, ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে আরুষি-হেমরাজকে। গল্ফ স্টিক দিয়ে মাথায় আঘাত করার পরে শল্যচিকিৎসার যন্ত্র দিয়ে তাদের গলার নলি কেটে ফেলা হয়। কিন্তু তলবারদের আইনজীবী যুক্তি দেন, গল্ফ স্টিক দিয়েই যে আঘাত করা হয়েছে, ময়নাতদন্ত বা ফরেন্সিক রিপোর্টে তা প্রমাণ হয়নি। খুনের অস্ত্রও হাজির করতে পারেনি পুলিশ। সিবিআই এই ঘটনাকে বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ বলে দাবি করলেও তলবারদের তরফে যুক্তি ছিল, খুনের কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণই মেলেনি। শুধুমাত্র পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দোষী ঠাওরানো হচ্ছে। সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা নিয়ে সিবিআইয়ের অভিযোগ, রাজেশ-নুপূর খুনের রাতেই কিছু জায়গার রক্ত ও অন্যান্য প্রমাণ মুছে ফেলেন। কিন্তু তলবারদের আইনজীবীর দাবি, পরের দিন পুলিশ অনুমতি দেওয়ার পরেই ফ্ল্যাট পরিষ্কার করানো হয়।
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ সাজা ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারক শ্যাম লাল বলেন, “এটা ঠিক যে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে পারিপার্শ্বিক প্রমাণ হাজির করা হয়েছে। তা থেকে মানুষের পক্ষে যতটা যা বোঝা সম্ভব, তাতে অপরাধ প্রমাণ হয়েছে।” তারই ভিত্তিতে আদালত খুনের অপরাধে তলবার দম্পতির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দশ হাজার টাকার জরিমানা করেছে। জরিমানা দিতে না-পারলে বাড়তি ছ’মাস জেল খাটতে হবে। তথ্যপ্রমাণ লোপাটের জন্য শাস্তি হয়েছে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। গোটা ঘটনা সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়ার দায়ে রাজেশের আরও এক বছরের জেল ও দু’হাজার টাকার জরিমানা হয়েছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিকে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বলেই কি তলবারদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হল? এর আগে হেতাল পারেখ ধর্ষণ ও খুনের মামলায় পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। তাঁর ফাঁসির শাস্তি হয়। তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত কারও মৃত্যুদণ্ড হওয়া সমীচীন কি না। সে ক্ষেত্রে তলবারদের মৃত্যুদণ্ড হলে বিতর্ক বাড়ত বই কমত না। বিচারক শ্যাম লাল অবশ্য তাঁর রায়ে এ সব কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, “এই দম্পতি সমাজের কাছে বিপজ্জনক নন। তাই এই মামলা ফাঁসির শাস্তি দাবি করে না।”
সামাজিক আন্দোলনকর্মী এবং আইনজীবী আভা সিংহের মতে, মৃত্যুদণ্ড না হয়েই ভাল হয়েছে। “সিবিআই একে বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা বলে দাবি করলেও খুনের পিছনে উদ্দেশ্য তারা প্রমাণ করতে পারেনি।” শুধু তাই নয়, তলবারদের আচরণে নানা সন্দেহজনক অসঙ্গতি থাকলেও তলবাররাই যে খুনি, তারও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলেনি। মেলেনি খুনের হাতিয়ারও। গত ১৫ মাসে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে শুনানির সময় সিবিআই বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, নয়ডার ওই ফ্ল্যাটে বাইরে থেকে কেউ ঢোকেনি। কাজেই আর কারও পক্ষে খুন করা সম্ভব ছিল না। সেই যুক্তিই মেনে নিয়েছে আদালত। বিচারক বলেন, “যদি বাইরের কেউ খুন করত, তা হলে নিহতদের আর্তনাদের আওয়াজ অভিযুক্তরা শুনতে পেতেন। সে তাঁরা যতই বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকুন না কেন! রাতে শব্দ আরও জোরে শোনা যায়।”
কিন্তু তলবারদের আইনজীবী-পরিবার-বন্ধুবান্ধবরা সকলেই তাঁদের দাবিতে অনড় আসল দোষীকে খুঁজে না পেয়ে ‘নির্দোষ’ চিকিৎসক দম্পতিকে বলির পাঁঠা করা হচ্ছে। আইনজীবী রেবেকা জনের বক্তব্য, “সিবিআইয়ের এই ফাঁসির দাবি করা থেকেই স্পষ্ট, এটা ডাইনি খোঁজার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। আদালতের পুরো আদেশ হাতে পেয়ে যত দ্রুত সম্ভব আমরা ইলাহাবাদ হাইকোর্টে আপিল করব।” রাজেশের ভাই দীনেশ তলবার, বোন শ্রী পরাদকর, আরুষির বন্ধুরা, নূপুরের বাবা-মা প্রত্যেকে এক বাক্যে বলছেন, “এ হয় না, হতে পারে না।” সকলেরই বক্তব্য আসল সত্যটা বাইরে আসা দূরস্থান, নির্দোষ বাবা-মাকে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। আরুষির চরিত্রে কালি ছেটানো হচ্ছে।
বস্তুত সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের নানা মহলেই আরুষি হত্যা মামলা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। প্রথম থেকেই পুলিশি তদন্তে অজস্র গাফিলতির অভিযোগ, সংবাদমাধ্যমের অতিসক্রিয়তা, একাধিক সাক্ষী এবং সিবিআইয়ের বয়ান বদল এই মামলাকে ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর করেছে। তথ্যপ্রমাণের অভাবের প্রশ্নটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই মামলাকে তাড়া করেছে। সিবিআই নিজেই এক সময় স্বীকার করেছিল, ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্য ৯০ শতাংশ তথ্যপ্রমাণ পুলিশের গাফিলতিতেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে রাখার কোনও চেষ্টাই করেনি। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা গিয়ে দেখেছিলেন, অজস্র লোকজন, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা বিনা বাধায় সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। |
এই দম্পতি নিয়মতান্ত্রিক সমাজের কাছে বিপজ্জনক নন। তাই এই মামলা ফাঁসির শাস্তি দাবি করে না।
শ্যাম লাল বিচারক |
|
১৯৬২, ১৯৬৯ আর ১৯৭১-এ দেশের
হয়ে লড়াই করেছি। আজ মনে হচ্ছে,
দেশ কি তবে আমায় এ-ই দিল?
বি জি চিটনিস
নূপুরের বাবা |
রাজেশ-নূপুর সম্পূর্ণ নির্দোষ। এমন সুখী স্বামী,
স্ত্রী আর দেখিনি। এরা ওদের জীবনটা
ধ্বংস করে দিল, আমাদেরও।
লতা চিটনিস
নূপুরের মা |
|
সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়েও যে অভিযোগ ওঠেনি, তা নয়। সিবিআইয়ের সামনেই আগের বয়ান থেকে পিছিয়ে আসেন ময়না-তদন্তকারী চিকিৎসকরা। সিবিআইয়ের প্রথম দল দাবি করেছিল, পলিগ্রাফ পরীক্ষায় ধৃত পরিচারক কৃষ্ণ-রাজকুমার এবং বিজয় নিজেদের দোষ স্বীকার করেছে। অথচ সিবিআইয়ের দ্বিতীয় দল তা অস্বীকার করে। রাজেশদের খাওয়ার টেবিলে পাওয়া হুইস্কির বোতলকে সিবিআই সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেছে। দাবি করেছে, খুন করার পর রাজেশ মদ্যপান করছিলেন। এ দিন রায়ে বিচারক সে কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ বোতলে পাওয়া আঙুলের ছাপের ডিএনএ পরীক্ষার কথা বলেছিলেন তলবাররা। তা করা হয়নি। আরুষির ঘরে হেমরাজকে মারা হলে সে ঘরে হেমরাজের রক্ত পাওয়া যায়নি কেন? উত্তর মেলেনি।
সিবিআইয়ের প্রথম দল রাজেশ-নূপুরকে অব্যাহতি দিয়ে কৃষ্ণদের দিকে আঙুল তুলেছিল। কিন্তু চার্জশিট দিতে পারেনি। দ্বিতীয় দলের তদন্ত ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে রাজেশ-নূপুরকে নিশানা করে। কিন্তু তারাও চার্জশিট দিতে পারবে না ধরে নিয়েই ক্লোজার রিপোর্ট দিয়েছিল। আদালতের নির্দেশে মামলা এগোয়। যে সিবিআই চার্জশিট দিতেই সন্দিহান ছিল, সেই সিবিআই-ই এ দিন আদালতে রাজেশ-নূপুরের ফাঁসি চেয়ে সরব হল! অনেকের চোখে ধন্দ রয়েই যাচ্ছে! কেন রাজেশ-নূপুরই খুনি, আদালত তার ২৬টা কারণ দর্শানোর পরও থেকে যাচ্ছে। তলবারদের আইনজীবীরা বলছেন, “লড়াই শেষ হয়নি, বরং শুরু হল।” |
পুরনো খবর: বাবা-মায়ের হাতেই খুন আরুষি, সাজা ঘোষণা আজ |
|
|
|
|
|