|
|
|
|
বাবা-মায়ের হাতেই খুন আরুষি, সাজা ঘোষণা আজ
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
‘কে করেছে’ নয়, ‘কে করেনি’-র সূত্র ধরে এগিয়েই আরুষি-হত্যা মামলার রায় ঘোষণা হয়ে গেল। গাজিয়াবাদে বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক শ্যাম লাল জানালেন, রাজেশ এবং নূপুর তলবারই তাঁদের মেয়ে আরুষি এবং হেমরাজের খুনি। কাল, তাঁদের সাজা ঘোষণা।
সোমবার দুপুর তিনটে ২৫ মিনিটে রায় বেরনোর পর আদালতের বাইরে এসে সিবিআই কৌঁসুলি আর কে সাইনি প্রথমেই জানান, “আদালত বলেছে, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির বিচারে আর কারও পক্ষে এই অপরাধ করা সম্ভব ছিল না।” খুনের (৩০২ ধারা) পাশাপাশি তলবার দম্পতির বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ লোপাট (২০১ ধারা), একাধিক জনে মিলে একই উদ্দেশ্যে চক্রান্তের (৩৪ ধারা) অপরাধও প্রমাণিত হয়েছে। রাজেশকে ২০৩ ধারায় অপরাধ সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রদানের দায়েও দোষী করা হয়েছে। রায় শুনে কেঁদে ফেলেন রাজেশ-নূপুর।
আইনজ্ঞরা অনেকেই মনে করছেন, আদালতের এই বিচারপদ্ধতি অনেকাংশে শার্লক হোমসের বিখ্যাত ‘মেথড অব এলিমিনেশন’ বা সম্ভাবনা খারিজ করার তত্ত্ব মেনে এগিয়েছে। যেখানে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নানা রকম সম্ভাবনার মধ্যে যেগুলো অসম্ভব, সেগুলোকে বাদ দেওয়া হয়। যেটা বাকি পড়ে থাকে, সেটাই সত্য বলে মেনে নেওয়া হয়। তলবার পরিবার অবশ্য বারবারই দাবি করছে, তদন্ত এবং বিচার দু’টোই একপেশে হয়েছে। রাজেশরা নির্দোষ। নির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়াই তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করা হল। সংবাদমাধ্যমের হইচই বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে বলেও তাঁদের অভিযোগ। ‘বেদনার্ত, আহত’ মন নিয়েই তাঁরা ‘সুবিচারের জন্য লড়াই’ চালিয়ে যাবেন বলে বিবৃতি দিয়েছেন তলবাররা। |
|
|
রাজেশ ও নূপুর। সোমবার আদালতের পথে। ছবি: পিটিআই। পাশে আরুষির ফাইল চিত্র। |
|
ঘটনা হল, রাজেশ-নূপুরের একাধিক সন্দেহজনক এবং অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণ প্রথম থেকেই তাঁদের সন্দেহের তালিকায় রাখলেও উত্তরপ্রদেশ পুলিশ বা সিবিআই, কেউই এ পর্যন্ত তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। বছর তিনেক আগে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ জমা দিয়েই তাই তদন্তে দাঁড়ি টানতে চেয়েছিল সিবিআই। সেই ক্লোজার রিপোর্টে অবশ্য তলবার দম্পতির প্রতিই আঙুল তোলা হয়েছিল। সিবিআই আদালত সেই রিপোর্টকেই চার্জশিট বলে গণ্য করে শুনানি শুরুর নির্দেশ দেয়। তলবাররা এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টও বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পক্ষে রায় দেয়।
আরুষি-হেমরাজের খুনিকে খুঁজতে গত সাড়ে পাঁচ বছরে সন্দেহের তির এক-একবার এক-এক দিকে গিয়েছে। প্রথম দিন হেমরাজ, তার পরে রাজেশ তলবার, তলবার ও তাঁদের বন্ধুদের পরিচারকরা, তার পর আবার তলবার-দম্পতি বৃত্তাকারে ঘুরেছে তদন্তের চাকা। পাল্লা দিয়ে বদলিয়েছে তদন্তকারী দলও। প্রথমে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ, তার পর সিবিআইয়ের প্রথম দল। তার পর সিবিআইয়ের দ্বিতীয় দল। বদলায়নি শুধু একটা জিনিসই কোনও তদন্তই রহস্যের পূর্ণাঙ্গ কিনারা করতে পারেনি। নানা ফাঁকফোকর, একাধিক প্রশ্নের মীমাংসা করা যায়নি। মেলেনি খুনের নির্দিষ্ট অস্ত্র।
তা হলে কী ভাবে বিচারক নিশ্চিত হলেন যে, রাজেশরাই খুনি? আইনজ্ঞদের বক্তব্য, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যখন কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, সাধারণত কোনও একটি সাক্ষ্যপ্রমাণ তাতে নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়ে থাকে। আরুষি মামলায় নির্ণায়ক ভূমিকা কীসের হয়, এ দিন সকাল থেকে এটাই ছিল তাঁদের কৌতূহলের জায়গা। সিবিআই আইনজীবী জানিয়েছেন, দু’পক্ষের সওয়াল জবাব শোনার পরে আদালত একটা বিষয়ে নিশ্চিত। ঘটনার দিন, আরুষিদের বাড়িতে বাইরে থেকে কেউ ঢোকেনি। আইনজীবী সাইনি নিজেও এ দিন আদালতকে এ কথাই বলেছেন “পারিপার্শ্বিক বলছে, রাজেশরাই খুনি। অন্য কেউ এ কাজ করেনি। অন্য কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়।” বিচারক সেই যুক্তি মেনে নিয়েছেন। তাঁর রায় বলেছে, “অভিযুক্তরাই যে অপরাধী, তা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত।” তাঁর মতে, আরুষি মামলা ইতিহাসের সেই বিরল ঘটনাগুলির মধ্যে পড়ে, যেখানে মা-বাবাই সন্তানের ঘাতক।
সাড়ে পাঁচ বছরের তদন্ত কী ভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল?
২০০৮ সালের ১৬ মে সাতসকালে নয়ডার ২৫ নম্বর সেক্টরের জলবায়ু বিহার আবাসনে তলবারদের ফ্ল্যাটে ১৪ বছরের আরুষির শোয়ার ঘরেই তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। নামী দন্তচিকিৎসক বলে পরিচিত রাজেশ
ও নুপূর তলবার যে নিজেদের একমাত্র মেয়েকে খুন করতে পারেন, সেটা কারওরই মনে হয়নি। বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক হেমরাজের কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। তলবার-দম্পতির পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ পুলিশও তখন হেমরাজের দিকেই অভিযোগের আঙুল তোলে। কিন্তু পর দিন ওই বাড়ির ছাদেই হেমরাজের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আরুষি ও হেমরাজের শরীরে একই রকম আঘাতের চিহ্ন মেলে।
গল্পের মোড় বদলাতে শুরু করে তখনই। পুলিশকে কিছুতেই ছাদের চাবি দিচ্ছিলেন না তলবাররা, বারবার বলছিলেন অন্যত্র তল্লাশি চালাতে এইখান থেকেই শুরু হয় সন্দেহ। প্রশ্ন ওঠে, মেয়ের ঘর আর বাবা-মায়ের ঘরের মধ্যে প্লাইউডের দেওয়াল! তা হলে কেন কিছুই টের পেলেন না বাবা-মা? তলবাররা কি পুলিশকেও হাত করার চেষ্টা করছেন? ময়না-তদন্ত বলল, আরুষি-হেমরাজের মাথায় গল্ফ স্টিকের মতো ভোঁতা কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। গলার নলি কাটা হয়েছে শল্য-চিকিৎসার যন্ত্রপাতি দিয়ে। ঘটনার এক সপ্তাহ পরে রাজেশকে গ্রেফতার করল পুলিশ।
তার পর থেকে মামলার অনেক জন অনেক দিকে গড়িয়েছে। সিবিআই শেষ পর্যন্ত আদালতে যে তত্ত্ব হাজির করেছে, তা হল— ঘটনার দিন রাতে একটা শব্দে রাজেশের ঘুম ভেঙে যায়। হেমরাজের ঘরে গিয়ে তাকে না পেয়ে তিনি গল্ফ স্টিক নিয়ে আরুষির ঘরে যান। সেখানে দু’জনকে আপত্তিজনক অবস্থায় দেখে রেগে গিয়ে হেমরাজের মাথায় গল্ফস্টিক দিয়ে মারেন। দ্বিতীয় বার মারতে গেলে হেমরাজ মাথা সরিয়ে নেয়। গল্ফ স্টিক গিয়ে লাগে আরুষির মাথায়। আওয়াজ শুনে নুপূর আরুষির ঘরে ছুটে আসেন। আরুষি, হেমরাজ দু’জনেরই তখন শেষ অবস্থা। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাদের গলার নলি কেটে দেওয়া হয়। রাজেশ-নুপূর হেমরাজের দেহ চাদরে মুড়ে ছাদে লুকিয়ে রাখেন। মেঝের রক্ত মোছার পর রক্তমাখা কাপড় ও খুনের সরঞ্জামও লুকিয়ে ফেলা হয়। এমন ভাবে ওঁরা গোটা ব্যাপারটা সাজান, যাতে মনে হয় হেমরাজের ঘর থেকেই বাইরের কেউ ঢুকেছিল।
গত ১৫ মাস ধরে সিবিআই আদালত রোমহর্ষক সওয়াল-জবাবের সাক্ষী থেকেছে। তলবারদের আইনজীবীরা কখনও হেলমেটে গল্ফস্টিকের বাড়ি মেরে, কখনও এক জনকে চাদরে মুড়ে টেনে-হিঁচড়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, তলবারদের পক্ষে এই খুন করা বা হেমরাজের মৃতদেহ লুকনো সম্ভব ছিল না। তলবারদের আইনজীবী যুক্তি দিয়েছেন, ঘটনাস্থলে রক্ত-ডিএনএ-আঙুলের ছাপ মেলেনি। ময়নাতদন্তে সরাসরি গল্ফ স্টিকের আঘাত প্রমাণ হয়নি। মদের বোতলে অপরিচিত পাঁচটি আঙুলের ছাপ ছিল।
কিন্তু সিবিআইয়ের আইনজীবী সাইনি বারবার একটি কথাই বলে গিয়েছেন ওই রাতে নয়ডার ফ্ল্যাটে বাইরে থেকে কারও ঢোকার প্রমাণ মেলেনি। ফ্ল্যাটে চার জনই ছিলেন। আরুষি, হেমরাজ, রাজেশ এবং নূপুর। প্রথম দু’জন নিহত। অন্য দু’জন যে প্রমাণ মোছার চেষ্টা করেছেন, আরুষির মৃতদেহ বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন, হেমরাজের দেহ লুকোনোর চেষ্টা করেছেন, সেই পারিপার্শ্বিক প্রমাণ রয়েছে। অতএব এই দু’জনই দোষী।
রাজেশ-নূপুরকে আজ দসনা জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাল সাজা শোনার পরে ইলাহাবাদ হাইকোর্টে আপিল করবেন তাঁরা। |
মা-বাবাই সন্তানের সবচেয়ে বড় রক্ষক...কিন্তু ইতিহাসে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে, যেখানে তাঁরাই ঘাতক... তলবাররা তাঁদের মেয়েকে হত্যা করেছেন, যে তখনও ১৪ বছরও পূর্ণ করেনি।
শ্যাম লাল, বিচারক |
|
যে অপরাধ করিনি, তার জন্য আমাদের দোষী সাব্যস্ত করা হল। আমরা অত্যন্ত হতাশ, আহত এবং বেদনার্ত। তবে পরাজয় স্বীকার করছি না। সুবিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব।
রাজেশ ও নূপুর তলবার |
|
পুরনো খবর: মা-বাবাই খুনি, ফের দাবি করল সিবিআই |
|
|
|
|
|