|
|
|
|
গোড়া থেকে রহস্যই সঙ্গী আরুষি মামলার
সংবাদ সংস্থা • নয়াদিল্লি |
চোদ্দো বছরের জন্মদিনটা ছিল আর আট দিন পরেই। স্বপ্ন, আনন্দ মাখা মুহূর্তগুলো শেষ পর্যন্ত আর আসেনি। মেয়েটাই শেষ হয়ে গিয়েছিল ২০০৮-এর ১৬ মে। বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আর নিজের ঘরের বিছানায় গলা-কাটা দেহ পড়ে আরুষির।
পরদিন সকাল হতে না হতেই ছড়িয়ে পড়ে খুনের খবর। দিল্লি পাবলিক স্কুলের মেধাবী ছাত্রী, নাচের দলের ‘গ্রুপ লিডার’ ওইটুকু মেয়েকে খুন করল কে? ঘটনাটা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি পড়শিরা, স্কুলের শিক্ষিকারা, আরুষির বন্ধুরা। গরমের ছুটি পড়ার আগে সে দিনই ছিল স্কুলের শেষ দিন। সময় পেরিয়ে গেল, মিষ্টি হাসির মেয়েটা এলই না।
আরুষির বাবা-মা ও পুলিশ উভয়ের সন্দেহের এক নম্বরে তখন নিখোঁজ পরিচারক হেমরাজ।
কাহিনির মোড় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল ২৪ ঘণ্টায়। সিঁড়িতে চাপ চাপ রক্তের দাগ আর ছাদে তোষকে মোড়া হেমরাজের বিকৃত দেহ মিললল যখন।
পরের চমক ঠিক ছ’দিনের মাথায়। সাংবাদিকদের ডেকে মেরঠের তৎকালীন আইজি গুরুদর্শন সিংহ বললেন, পরিচারকের সঙ্গে মেয়েকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিলেন রাজেশ। রাজেশের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কথাও জেনে ফেলেছিল আরুষি। তাই পরিবারের সম্মান বাঁচাতে আরুষি-হেমরাজকে গল্ফ স্টিক দিয়ে খুন করেছেন রাজেশই।
ক’দিন মাত্র হল খুন হয়েছে ফুটফুটে মেয়েটি। তার চরিত্রের প্রতি আঙুল তোলা, গুরুদর্শনের অপরিমার্জিত বাচনভঙ্গি দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ক্ষোভ। সংবাদমাধ্যমে সমালোচনার ঝড়। আরুষির ছবি আর মোমবাতি হাতে রাজধানীর রাস্তায় নামল তার বন্ধু, শিক্ষিকা থেকে শুরু করে দিল্লির আম-জনতাও। সরব হল দেশের শিশু অধিকার রক্ষা সংগঠনগুলি। সিবিআই তদন্তের দাবি করে মুখ খুলল আরুষির পরিবার।
সাড়ে পাঁচ বছর আগের সেই সময়টা তখন একের পর এক হইচই ফেলে দেওয়া মামলা আর নাগরিক সমাজের প্রতিবাদে মুখর। জেসিকা লাল, প্রিয়দর্শিনী মাট্টু, নীতীশ কাটারার নামের সঙ্গে তখন একসঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে আরুষির নাম। তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ তুলে চ্যানেলে চ্যানেলে তর্ক-বিতর্ক। টিভির পর্দায় নূপুর তলবারের আশ্চর্য শান্ত-সংযমী চেহারা, চোখের তলায় গাঢ় কালি দেশবাসীর কাছে তিনি তখন শোকের প্রতীক। নূপুর বলতেন, দক্ষিণ দিল্লির বাড়ি ছেড়ে নয়ডার ফ্ল্যাটে উঠে আসা তো এই মেয়েরই জন্য। মেয়ে ভাল স্কুলে পড়বে বলে কত কষ্ট করা! আর তাঁদেরই বিরুদ্ধে কি না খুনের অপবাদ দিচ্ছে পুলিশ! মেয়েকে হারিয়েছেন, এখন স্বামীকেও হারাতে বসেছেন!
পরিণাম? গুরুদর্শনকে তড়িঘড়ি বদলি করে দিল মায়াবতী সরকার। তদন্তের ভার নিল সিবিআই।
এ বার আটক হলেন ওই আবাসনেরই তিন কর্মী কৃষ্ণ, রাজকুমার আর বিজয়। হেমরাজের ঘরে ঘাঁটি গেড়ে তারাই খুন করেছিল দু’জনকে? নার্কো অ্যানালিসিস, লাই-ডিটেক্টরের মতো বাঘা বাঘা পরীক্ষা শেষেও ওই তিন জনের নামে যথেষ্ট প্রমাণ জোগাড় করতে পারল না সিবিআই। জমা পড়ল না চার্জশিটও। বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন কৃষ্ণরা। |
আরুষি-নামা |
• ২০০৮, ১৬ মে: আরুষির দেহ উদ্ধার। সন্দেহ পরিচারক হেমরাজকে।
• ১৭ মে: হেমরাজের দেহ উদ্ধার।
• ২৩ মে: রাজেশ তলবার গ্রেফতার।
• ১ জুন: পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন। তদন্তভার সিবিআইকে।
• ১৩ জুন-১১ জুলাই: পরিচারক কৃষ্ণ, রাজ কুমার এবং বিজয় মণ্ডল ধৃত।
• ১১ জুলাই: রাজেশের জামিন
• ২০০৮, জুলাই: চার্জশিট দিতে পারল না সিবিআই, ধৃতেরা মুক্ত।
• ২০০৯, সেপ্টেম্বর: তদন্তে সিবিআই-এর দ্বিতীয় দল।
• ২০১০, ২৯ ডিসেম্বর: সন্দেহ তলবারদেরই, তবে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। ক্লোজার রিপোর্ট সিবিআইয়ের।
• ২০১২, ৬ জানুয়ারি: সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ফের বিচার শুরু। ৩০ এপ্রিল: আত্মসমর্পণ নুপূর তলবারের।
• ২৫ সেপ্টেম্বর: জামিন পেলেন নূপুর।
• ২৫ মে: তলবারদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন।
• ২০১৩, ২৫ নভেম্বর: দোষী সাব্যস্ত তলবার দম্পতি। |
|
আরুষি মামলা যে কতটা ঘোরালো, সেটা ফের প্রমাণিত হল সিবিআইয়ের দ্বিতীয় দল তদন্ত শুরু করার পরে। খুনের জায়গা খুঁটিয়ে দেখা, নিত্য নতুন পরীক্ষা, আবার এক প্রস্ত সাক্ষ্যগ্রহণ। শেষ চমকটা বাকি ছিল তখনও। ২০১০ এর ডিসেম্বরে মামলার রিপোর্ট জমা দিল সিবিআই এ বার আবার ঘুরেফিরে সেই প্রথম প্রতিপাদ্য! সম্মানরক্ষার্থে খুনের তত্ত্ব! কাঠগড়ায় সেই রাজেশ-নূপুর তলবার!
স্নেহশীল বাবা-মা, নামী চিকিৎসক থেকে অভিজাত খুনির তকমা।
এ দিন রায় বেরনোর পরও কিন্তু বিষয়টা মানছে না তলবার পরিবার। নূপুরের বোন বন্দনা বলছেন, “পুরো মামলাটাই সাজানো। নিজেদের দোষ ঢাকতে দিদিদের ফাঁসাল সিবিআই।” হতাশা ঝরে পড়েছে রাজেশের ভাই দীনেশের গলাতেও। “এর আগে তো সিবিআই-ই বলেছিল পরিচারকরাই দোষী। কোনও প্রমাণ জোগাড় না করে দোষ চাপাল অন্যদের ঘাড়ে।” বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না ফিজা ঝা’রও। আরুষির বন্ধু সে। “কাকু-কাকিমা কী করে এমন কাজ করবেন, নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে”, বলেছে সে।
সিবিআই যেমন রাজেশদের আচরণে বহু অসঙ্গতির কথা বলছে, সন্দেহজনক গতিবিধির কথা বলছে, একই ভাবে তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে কখনও পুলিশ, কখনও সিবিআইয়ের নানাবিধ পরস্পরবিরোধী দাবিদাওয়ার কথা তুলছেন তলবাররাও।
বাস্তবিকই, এত বছর বাদে রায় বেরোলেও উত্তর মেলেনি বহু প্রশ্নের। রহস্যে মোড়া এই খুন নিয়ে পুরোপুরি ধোঁয়াশা কাটেনি। হাইকোর্টে আরও কোনও চমক অপেক্ষা করে আছে কি না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায় গোটা দেশ। |
ধন্দ যেখানে |
সিবিআই: দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। বাইরে থেকে খুনি ঢুকবে কী ভাবে?
তলবার: আমাদের বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
সিবিআই: বাড়িতে ওই চার জন ছাড়া কেউ ছিল না।
তলবার: মদের বোতলে অন্য পাঁচ জনের হাতের ছাপ মিলেছে।
সিবিআই: গল্ফ স্টিক দিয়ে মারা হয়। সেটা বাড়ি থেকেই উদ্ধার হয়।
তলবার: খুকরি দিয়েও ভোঁতা আঘাত সম্ভব। গল্ফ স্টিক সিবিআইয়ের বানানো গল্প।
সিবিআই: সেই রাতে তলবাররা জেগেছিলেন, ইন্টারনেট সার্ফ করছিলেন
তলবার: ঘুমিয়ে ছিলাম।
সিবিআই: খুনের রাতেই সব প্রমাণ লোপাট।
তলবার: পুলিশের উপস্থিতিতেই আরুষির ঘর সাফ হয়।
সিবিআই: আরুষির ঘরেই হেমরাজকে মেরে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সিঁড়িতে ছিল রক্তের দাগ।
তলবার: হেমরাজ আরুষির ঘরে ছিল, এমন প্রমাণ নেই। কেউ সিঁড়িতে রক্ত পায়নি।
সিবিআই: তলবাররা ছাদের চাবি দিচ্ছিলেন না। পরে সেখানেই মেলে হেমরাজের দেহ।
তলবার: এই দাবি সত্য নয়।
সিবিআই: মদের বোতলে আরুষি-হেমরাজের রক্ত। খুনির হাতের ছাপ মোছা হয়েছে।
তলবার: রক্ত নিয়ে ফরেন্সিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। বোতলে আমাদের হাতের ছাপ নেই
সিবিআই: হেমরাজের বিরুদ্ধে রাজেশের ভুয়ো এফআইআর
তলবার: প্রাথমিক ভাবে সবাই হেমরাজকেই সন্দেহ করেছিল।
সিবিআই: হেমরাজের দেহ শনাক্ত করতে চাননি রাজেশ।
তলবার: উত্তরপ্রদেশ পুলিশ এটা পরে বানিয়ে বলেছে সিবিআইকে। |
|
|
|
|
|
|