|
|
|
|
হাওড়ার ফলে চমক নেই, বাড়ল প্রত্যাশার চাপ |
দেবাশিস দাশ ও শান্তনু ঘোষ • কলকাতা |
প্রবণতা স্পষ্ট ছিল। ফলাফল তাই খুব অপ্রত্যাশিত নয়।
পরিবর্তনের হাওয়ায় গত আড়াই বছরের মধ্যেই হাওড়ার সব ক’টি বিধানসভা ও লোকসভা আসন হারিয়েছিল বামফ্রন্ট। এ বার হারাল হাওড়া পুরসভাও। ৩০ বছর ধরে টানা হাওড়া পুরসভা দখলে রাখার পরে সপ্তম পুর-নির্বাচনে তৃণমূলের কাছে ধরাশায়ী হল বামেরা। এ বার নির্বাচনে এখনও পর্যন্ত ৫০টি আসনের মধ্যে ৪১টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হাওড়া পুরবোর্ড গঠন করছে তৃণমূল। চারটি আসন পেয়ে বিরোধী আসনে বসছে কংগ্রেস। বামফ্রন্ট আর বিজেপি রয়েছে তৃতীয় স্থানে। দু’দলই দু’টি করে আসন পেয়েছে। একটি আসনের ফল ঘোষণা স্থগিত রয়েছে। সেখানে একটি বুথে ফের ভোট নেওয়া হবে। তবে তাতে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ বোর্ড গঠনের কোনও হেরফের হবে না।
হাওড়া পুরসভা গঠনের পরে ১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত মোট ছ’টি নির্বাচনে হাওড়া পুরসভা দখলে রেখেছিল বামফ্রন্ট। এত বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও বিরোধী ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ ছিল, হাওড়া শহরের যতটা উন্নতি হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। প্রতি ক্ষেত্রেই পরিষেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বাম-শাসিত পুরর্বোড। অভিযোগ ছিল, এখনও বৃষ্টি হলে বানভাসি হয় হাওড়া। গৃহস্থের রান্নাঘরে ঢোকা নর্দমা উপচানো পাঁকজলে বসে রান্না করতে হয় গৃহিণীদের। মাসে একাধিক বার পানীয় জলের সঙ্কটে পড়তে হয় নগরবাসীকে। এ সবের প্রেক্ষিতে স্বাভাবিক ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল এ বারে হাওড়ার পুর-নির্বাচনের ফলাফল। |
|
বিজয়োল্লাস। সোমবার, হাওড়ায়। —নিজস্ব চিত্র। |
পুর-পরিষেবার মান দিনের পর দিন এতটাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল যে, সম্প্রতি হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ৫০টি ওয়ার্ডে তৃণমূলের থেকে বামফ্রন্ট ১৫টিতে এগিয়েছিল। তা আরও কমে এ বার মাত্র দু’টি ওয়ার্ড নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে বামেরা। পাশাপাশি, গত বিধানসভা নির্বাচনেও হাওড়া পুর-এলাকার ৪টি বিধানসভা কেন্দ্রেই তৃণমূল জয়লাভ করলেও বামফ্রন্ট ছিল দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু পুরনির্বাচনে বামেদের স্থান হয়ে গেল তৃতীয়।
পুরসভার পরিষেবায় কিছু ফাঁক থেকে যাওয়ার জন্যই যে এ বারের নির্বাচনের ফলাফল এতটা খারাপ হয়েছে, তা কার্যত মেনে নিয়েছেন হাওড়া জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক বিপ্লব মজুমদার। তিনি বলেন, “এ বারের নির্বাচনে ৫০টি ওয়ার্ডের মধ্যে অর্ধেক ওয়ার্ডে সন্ত্রাস হয়েছে। বাকি অর্ধেক ওয়ার্ডে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন নাগরিকেরা। কিন্তু সেখানেও আমাদের ফল আশানুরূপ হয়নি। আগেই বলেছিলাম, পুরসভার উন্নয়নের কাজে কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছে। তাই যে সমস্ত ভোটারেরা নিজের অধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন, তাঁরা মনে করেছেন শাসক দলের হাতে ক্ষমতা দিলে শহরের উন্নয়ন হবে।”
অন্য দিকে, কংগ্রেসও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে যে, এই পরিস্থিতিতে চারটি আসনে জয় পেয়ে তারা সন্তুষ্ট। জেলা কংগ্রেস সভাপতি কাজী আব্দুল রেজ্জাক বলেন, “সর্বত্র সন্ত্রাস হয়েছে, এ কথা বলাটা অযৌক্তিক। মোটের উপরে ভোট ভালই হয়েছে। বামেদের লাল দুর্গ উত্তর হাওড়ায় আমরা সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল। তবে মধ্য এবং দক্ষিণ হাওড়া মিলিয়ে আমরা চারটি আসন দখল করতে পেরে খুশি।”
তৃণমূলের সন্ত্রাস না হলে এই নির্বাচনেও আরও কয়েকটি বেশি আসন পেয়ে তারা দ্বিতীয় স্থানেই যেত বলে দাবি বিজেপি-র জেলা নেতৃত্বের। হাওড়ায় বিজেপি-র জেলা নেতা শ্যামল হাতি বলেন, “আমরা এ বার নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে উন্নয়নের স্বার্থে ভোট চেয়েছিলাম। মানুষ ভোট দিয়েছেন। তবে তৃণমূল সন্ত্রাস না করলে আরও কয়েকটি আসন পেতাম।” তৃণমূলের জেলা সভাপতি (শহর) অরূপ রায়ের বক্তব্য, “১৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি-র জয়লাভ প্রমাণ করে দেয় উত্তর হাওড়া যে রিগিংয়ের অভিযোগ উঠেছে, তা মিথ্যে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাওড়ায় রাজধানী সরিয়ে এনে উপহার দিয়েছেন। এই জয়ের মাধ্যমে মানুষ তার দাম দিল। নতুন বোর্ডকে অনেক কাজ করতে হবে।”
ফলাফল যেহেতু প্রত্যাশিত ছিল সোমবার হাওড়া ডুমুরজলা স্টেডিয়ামের ভোটগণনা কেন্দ্রের সামনে সকাল থেকেই তৃণমূলের নেতা, কর্মী সমর্থকেরা ভিড় জমিয়েছিলেন। বেলা যত গড়িয়েছে, সেই ভিড় তত বেড়েছে। একটার পর একটা আসনে তৃণমূল প্রার্থীদের জয়লাভের ঘোষণায় উল্লাসে ফেটে পড়েছেন গণনাকেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষারত হাজার হাজার কর্মী-সমর্থকেরা। আকাশে উড়ছে সবুজ আবির। স্টেডিয়ামের সামনে কংক্রিটের রাস্তার রং পাল্টে গিয়েছে।
সময় যত এগিয়েছে তৃণমূলের পতাকা, কর্মীদের সবুজ আবিরে মাখা উল্লাস ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়েছে হাওড়ার অলিতেগলিতে। ব্যাঞ্জো, ঢোল, তাসার সঙ্গে চলেছে নাচ। এর মধ্যে ইন্দ্রপতন হয়েছে। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন মেয়র মমতা জায়সবাল। ১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন সিপিআই-এর প্রার্থী ডেপুটি মেয়র কাবেরী মৈত্র। এর পরে যত ভোটবাক্স খুলেছে, তত বেরিয়ে এসেছে বামফ্রন্টের পরাজয়ের খতিয়ান। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই জানা গিয়েছে প্রত্যাশিত ফলাফল। ৫০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৯টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। যার মধ্যে ৪১টি আসনে জয় পেয়েছে তৃণমূল। ৪টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস এবং দু’টি করে আসন পেয়েছে বামফ্রন্ট ও বিজেপি। শুধুমাত্র ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথের ইভিএমে গোলমাল হওয়ায় এ দিন ওই ওয়ার্ডের ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। রাজ্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ওই বুথে ২৭ তারিখ পুনর্নির্বাচন হবে। এর পরেই ঘোষণা করা হবে ওই ওয়ার্ডের ফলাফল।
দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ এ বার নতুন পুরবোর্ডের কাছে সুদে-আসলে মিটিয়ে নিতে চান হাওড়ার বাসিন্দারা। শহরের বাসিন্দা বিশিষ্ট কয়েক জন ব্যক্তির কথাতেই তা স্পষ্ট। যেমন প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “হাওড়া নিয়ে অনেক অভিমান রয়েছে। কলকাতার থেকে পুরনো এই শহরটা পরিষেবার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। সাধারণ মানুষ হিসেবে একটি মাত্র চাওয়া— সুষ্ঠু পরিবেশ ও সুশাসন।” লেখক নারায়ণ দেবনাথ বলেন, “রাস্তায় বেরোলেই উঁচু উঁচু বাড়ি ছাড়া আর তেমন কিছুই চোখে পড়ে না। তাই নাগরিক ও সামাজিক পরিষেবা সুষ্ঠু ভাবে পাবো, এই আশাই রাখি।” আবার “রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে নাগরিক পরিষেবাই যেন নতুন পুর-বোর্ডের কাছে এক মাত্র লক্ষ্য হয়,” মন্তব্য পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের। ক্রিকেটার সৌরাশিস লাহিড়ীর কথায়, “শহরটা আরও সুন্দর হয়ে উঠুক। রাতে রাস্তায় যাঁরা শুয়ে থাকেন, তাঁরা যেন থাকার একটি জায়গা পান।”
তৃণমূলের অন্দরের খবর, পুরবোর্ডে বড় দায়িত্ব পেতে চলেছেন ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের জয়ী প্রার্থী, চিকিৎসক রথীন চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, “কোমায় আক্রান্ত এক রোগীর মতো অবস্থা হাওড়া শহরের। সুষ্ঠু চিকিৎসা দিয়ে ফের দুয়োরানি হাওড়াকে তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনাই হবে আমাদের আসল চ্যালেঞ্জ।” |
|
|
|
|
|