তিরতির করে বয়ে চলেছে আমার ছোট নদী। কিন্তু তার চলার পথ নির্দিষ্ট হয়ে গেছে নির্মাণকাজের জন্য।
অচিরেই চাপা পড়বে এই জলশিরা। তাকে দেখে অনেক দূরের এ রকমই ছোট একটি নদীকে মনে পড়ল খুব।
জয়া মিত্র |
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে আমাদের হাউসিংয়ের আশেপাশে যে-সব জায়গা কুড়ি বছর আগে মাঠ, তালবন ও ধানখেত ছিল, এখন যেখানে প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন বাড়ি উঠছে আর ফাঁকা জায়গাগুলো পাঁচিল-চিহ্নিত, তার প্রান্তে, কিছু খেজুরগাছ ও ঝোপঝাড় নিয়ে অবশিষ্ট এবড়োখেবড়ো জমিতে তাকে দেখলাম, নদীটিকে। জানি, কোনও রকমেই নদী বলা যাবে না ওই জলধারাকে। কিন্তু সে একটি নদীর অঙ্কুর। বীরভূম-মানভূমের ঝুরো কাঁকুরে মাটি থেকে এমন করেই নদীরা ফুটে ওঠে, যেন পায়ে-হাঁটা জলধারা। মাটির অল্প নীচে থাকা জলের ধারা কোন ফল্ট লাইন বেয়ে এমন বিড়বিড় করে কথা বলার মতো উঠে আসে, সে উত্তর হয়তো দেবেন ভূতত্ত্ববিদরা। আমরা কেবল অবাক হয়ে দেখি, যে জলের ধারাটিকে তার জন্মঘরে দেখলে মনে হয় বুঝি পাঁচ হাতও চলতে পারবে না, বিশ হাত পর দেখি, সে দিব্যি এক ক্ষীণ স্রোতস্বিনীর চেহারা নিয়েছে। আশপাশ থেকে আসা এ রকমই ছোট ছোট ধারা কুড়িয়ে আরও দূর যাওয়ার পর তাদের নাম হয় কাঁসাই কি কোপাই। সুবর্ণরেখা, ন্যাংসাই, অজয়। আমার খুঁজে পাওয়া জলবালিকাও মাঠের ওপর দিয়ে আঁকাবাঁকা গড়িয়ে গিয়ে কাছেই গাড়ুই নদীকে পুষ্ট করত। ‘করত’ বললাম, কেননা, এখনও পুরনো খেতজমির কিনার দিয়ে বহমান কয়েক ইঞ্চি চওড়া জলে দেখা যাচ্ছে বটে স্রোতের চলন, কিন্তু বিশ-পঁচিশ হাত দূরেই তার তিন দিক ঘিরে এগিয়ে আসছে ইট-সিমেন্টের পাঁচিল। এখনও জীবিত ওই জলের ধারা প্রকৃতির নিজস্ব প্রসাদ, কিন্তু এখানেই শেষ তার বেঁচে থাকা। মেয়েদের হেঁটে যাওয়া ওই মাঠ পথ, তার পাশে ছোট পুকুর, সব নির্দিষ্ট হয়ে গেছে নির্মাণকাজের জন্য। সেখানেই কোথাও চাপা পড়বে এই জলশিরা। তার পর সে যাবে কোথায়, কোন গহ্বরে জমা করবে নিজের শক্তি, আমরা আর জানব না। |
যে নদী নদীপথে। এই দৃশ্য কিন্তু কলকাতার কাছেই। গত বছরের। ছবি: ভুবনেশ্বরানন্দ হালদার |
অনেক দূরের এ রকমই ছোট অন্য এক নদীকে মনে পড়ল খুব। মেয়েদের পরিশ্রমের যত্নে বেঁচে ওঠা সে-নদীর নাম গড়গঙ্গা। গাড়োয়ালে ১৫ জুনের যে ধ্বংস প্রত্যক্ষ করল সারা পৃথিবী, সেখানকার পৌরি জেলার একটি ছোট তহসিল দুধাতোলি। নাম থেকেই স্পষ্ট যে, প্রচুর গরু এ অঞ্চলে। জঙ্গলের ভেতরে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রামগুলোর প্রধান জীবিকা পশুপালন। দৌণ্ড, দুলমোট, জান্দ্রিয়া, উফরেংখাল এই সব গ্রাম নিয়ে একটি বড় অঞ্চলের নাম গড়খড়ক। ‘খড়ক’ মানে জঙ্গলের মধ্যে কাঠের শক্ত বেড়া দিয়ে ঘেরা পশু রাখার জায়গা। আশির দশক পর্যন্ত ক্রমশ বিপন্ন হচ্ছিল গ্রামের মানুষ। সরকারি পারমিট নিয়ে আসা ব্যবসায়ীদের দৌলতে বৃক্ষশূন্য হয়ে যাচ্ছিল পাহাড়। বনসৃজনে পুরনো খালি জায়গায় বসানো হচ্ছিল কেবল পাইন। প্রাচীন ওক, অলডার, গুরাস ইত্যাদি চওড়া পাতার গাছ পশুখাদ্য হওয়া ছাড়াও তলায় ঘাস ও ঝোপঝাড় পালন করত। আশ্রয় হত অন্য নানান ছোট প্রাণীর। পাইন সেই ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে না, সে কেবল মনুষ্য ব্যবহারের কাঠ ও তেল। পাইনের ছুঁচলো তৈলাক্ত ঝরা পাতা শুধু যে অন্য ছোটগাছ জন্মানোর বাধা হয়ে হিউমাস নষ্ট করে তা-ই নয়, সহজে আগুন ধরে যায়। বর্ষার সময়ে তীব্র ধারায় নেমে আসা বৃষ্টিজল বিপুল ভূমিক্ষয় ঘটাত বড় বৃক্ষবিহীন খাড়া উঁচু পাহাড়ে। সেই জল ও মাটি গিয়ে নামত রামগঙ্গার বুকে। দুধাতোলির পুরুষদের গরু-মোষ-ছাগল-ভেড়া নিয়ে চলে যেতে হত গ্রাম থেকে অনেক অনেক দূরে, অনেক মাসের জন্য। পরিবারগুলো ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। বেড়ে চলেছিল পাহাড়ের বস্ত্রহরণ আর ভূমিক্ষয়। গ্রামে পড়ে থাকা স্বজনহারা মেয়েরা উপায় খুঁজছিলেন সুস্থ ভাবে বাঁচার। ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী চামোলি জেলায় চণ্ডীপ্রসাদ ভটের নেতৃত্বে ‘চিপকো’ আন্দোলন শুরু হয়েছে মূলত মেয়েদেরই প্রয়াসে।
উফরেংখাল গ্রামের স্কুলের শিক্ষক সচ্চিদানন্দ ভারতী নিজের গ্রামের এই সমস্যাগুলোর সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত ছিলেন। তাঁর মা’কেও যেতে হত পাশের গ্রামের জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়োতে। ছাত্রজীবনে চামোলির চিপকো আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন সচ্চিদানন্দ। নিজের গ্রামের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর। কথা বলা শুরু করলেন নিজের ও আশপাশের গ্রামের লোকদের সঙ্গে। ভাবনার শুরু থেকেই সক্রিয় ভাবে যোগ দেন আরও কয়েক জন। মুখে-মুখে খবরাখবর দেওয়ানেওয়া চলে। পাঁচটা গ্রামে ছড়ায় এই ইচ্ছা আর উদ্যোগের কথা। ১৯৮০ সালে সচ্চিদানন্দের উদ্যোগে কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে একশো-দেড়শো জন মিলে তিন দিনের এক আলোচনাসভা হল উফরেংখাল গ্রামে। উঠে এল ভূমিক্ষয় রোধ আর জঙ্গল ফিরিয়ে আনার দরকারি কথা। তার পর উৎসাহী ক’টি গ্রাম নিয়ে তৈরি হল ‘দুধাতোলি লোক বিকাশ সংস্থান’। নিজেরাই কাজ ঠিক করা, দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া, সেই মতো কাজ। শুরু হয়ে গেল জঙ্গল বাঁচিয়ে আর একটু ভাল বাঁচার চেষ্টা। গ্রামের মেয়েরা, বাচ্চারা সারা দিন এধার-ওধার থেকে দেশি গাছের বীজ কুড়িয়ে জড়ো করতে শুরু করল। মাটিতে লম্বা গর্ত কেটে বৃষ্টির জল ধরার পুরনো কাজ ভুলে গিয়েছিল লোকে, আবার শুরু হল তার চর্চা। এই লম্বা অগভীর গর্তকে বলে খাল। উপরে খাল ছিল বলেই গ্রামের নাম উফরেংখাল। শুরু হল গড়িয়ে যাওয়া বৃষ্টির জল ধরে রাখার আর এক কৌশল পাহাড়ের ঢালু গা ভরে ছোট ছোট গর্ত কাটা। এগুলোকে বলে চাল। এক-একটা চাল বৃষ্টিতে ভরে ওঠে, সেই জল মাটিতে ঢুকে যায়, আবার ভরে। এক-একটা চাল দিয়ে এক বর্ষায় ৬০/৭০ কিউবিক ফুট জল পাহাড়ের ভেতরে যায়। পুরো পাহাড় জুড়ে খাল আর চাল কাটা হতে লাগল। ১৩৬টি গ্রাম মিলিয়ে মোট ১২ হাজার চাল কাটা হয়েছে।
‘মহিলামঙ্গল দল’ গড়ে দিশি গাছের নার্সারি তৈরি করলেন মেয়েরা। চারা বসানো হতে লাগল এক-একটি চালের গা ঘেঁষে। ‘ওই জলটা ধরে নাও যে গাছদের মায়ের দুধ। শেকড় দিয়ে খেয়ে এরা জলদি জলদি বড় হবে’, বলেন সেই পার্বতীরা, দৈনিক ছয়-সাত-আট মাইল হেঁটে যাঁরা ওই গাছের দেখাশোনা করেন। টিহ্রি-গাড়োয়াল জেলার প্রাচীন নাম ‘সহস্রতাল’, জল রাখার হাজার রকম কৌশল জানবেন বইকী সেখানকার মানুষ। ১৯৯২ সালে চার লক্ষ চারা হয় নার্সারিতে। ‘লোক বিকাশ সংস্থান’-এর সদস্যরা বনবিভাগকে জানান, পাশের কিছু অঞ্চলের গ্রামে দু’লক্ষ চারা দান করতে চান তাঁরা। রাজ্যের তৎকালীন ফরেস্ট সেক্রেটারি জি সি পন্থ জেলাশাসককে পাঠান দেখে আসতে। নবজাত জঙ্গল ও তার পালকপালিকাদের দেখে, তাঁদের কথা শুনে অভিভূত প্রশাসক জানান যে, দান নয়, চারা প্রতি পঞ্চাশ পয়সা করে দু’লক্ষ গাছ কিনবেন তাঁরা এই অসাধারণ কাজকে সমর্থন জানিয়ে।
২০০১ সালের অনাবৃষ্টির সময়ে উত্তরাখণ্ডের কয়েক হাজার হেক্টর জমির বন পুড়ে যায়। উফরেংখালের বন বেঁচেছিল, কারণ এখানকার জমি ছিল ভেজা। যদিও কাছাকাছি সরকারি বনাঞ্চলের আগুন নেভাবার জন্য আপ্রাণ কাজ করেন গ্রামবাসীরা। তিন জন মেয়ে পুড়ে মারা যায়। ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে গুরাসের লাল-গোলাপি ফুল আর ঘন পাতায় ঝলমল করছিল পঞ্চাশ-ষাট ফুট উঁচু ঘন জঙ্গল। নীচে হিউমাসের ভারী লেপ। ছোট ছোট প্রাণীদের নিঃশব্দ চকিত চলাফেরা। পাখিদের ছোট উড়াল। মহিলামঙ্গল সদস্যাদের ছয়-সাত জনের দল পাহাড়ি পথে হেঁটে ঘরে ফিরছিল। কাঁধে লাঠির মাথায় এক জোড়া পেতলের ঘুঙুর। ওকে বলে খাঁকর। নিস্তব্ধ জঙ্গলে খাঁকরের ঝুনঝুন শব্দ জানান দেয়, জঙ্গলজননীরা বনের তদারক করছেন। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় খাঁকর নামিয়ে রাখবে প্রতিবেশিনীর দরজায়, কাল তার পালি। ক্লান্ত উজ্জ্বল মুখগুলো ঝলমল করে:
ঘরে আমাদের বাচ্চারা আছে। ঘরের লোক আর দূরে যায় না। এখানে এখন অনেক ঘাসপাতা, জল...
তোমরা এত কষ্ট করে গাছ বানিয়েছ, আর ওরা গরু দিয়ে খাইয়ে দেয়! খেপাই আমি, তারাও হেসে কুটিপাটি হয়...
বড় গাছ কি খায় গায়-ভৈঁস? ঘাস খায় তো!
জঙ্গলে এখন ত্রিশ হাজার গৃহপালিত পশুর খড়ক। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বর্ষার জল নিয়ে নামা ‘সুখারৌলা’ এখন বারোমাসের নদী। নাম হয়েছে গড়গঙ্গা। গড় খড়কের ‘গড়’ আর গাড়োয়ালের সব জলধারাই তো গঙ্গা।
সুন্দর করে চলে মানুষদের নিজস্ব জীবন, যতক্ষণ না অনেক দূরের অন্য কেউ ঠিক করেন অন্য কিছু। তার পর লালনকারিণী নদীরা প্রলয়ঙ্করী হয়। দূর নদীতীরবর্তী গ্রাম থেকে আর্ত আবেদন আসে, ‘আমাদের গ্রামের চল্লিশ জন ছেলেমেয়ে ১৫ জুন পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। তারা ফিরে আসেনি’ |