প্রবন্ধ ১...
বিপ্লবের স্বপ্ন থেকে ক্ষমতার ভাষা
ক্ষমতার যে নিজস্ব ভাষা রয়েছে, তা আজ আর অজানা নয়। ক্ষমতার ভাষার আঁচ বাঁচিয়ে চলা সম্ভব কি না, অথবা কে কতটা চলতে পারেন, সে অন্য প্রসঙ্গ। তবে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ বদলে দেওয়ার স্বপ্ন যাঁরা ফিরি করেন, তাঁরা যখন ক্ষমতার ভাষায় কথা বলেন, তখন তা আরও বেশি শ্রুতিকটু হয়। বন্দুকের নলকেই যাঁরা ক্ষমতার উৎস বলে মনে করতেন, নেপালের সেই মাওবাদীরা বছর পাঁচেক আগে যখন সংসদীয় গণতন্ত্রের ছকে ক্ষমতায় এলেন, তখন অচিরেই ক্ষমতার চিরাচরিত ভাষা তাঁদের নেতা ও কর্মীদের একাংশকে গ্রাস করে ফেলল। এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাওবাদী নেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে পুষ্পকমল দহাল ওরফে প্রচণ্ড সম্পর্কে বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার অভিযোগ শোনা গেছে বার বার। সে অভিযোগ এনেছেন তাঁর দলের ‘কমরেড’রাও।
মাওবাদীদের সম্পর্কে নেপালের অধিবাসীদের এই যে মোহভঙ্গ, তারই প্রতিফলন এ বারের সাংবিধানিক গণপরিষদের নির্বাচনে। যে সব কেন্দ্রে সরাসরি ভোট হওয়ার কথা, তেমন দু’দুটি কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী)-র সভাপতি প্রচণ্ড। দক্ষিণ নেপালের সিরাহা-৫ ভোটকেন্দ্রে তিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাত্র ৯০০ ভোটে হারালেও কাঠমান্ডু-১০ কেন্দ্রে পেয়েছেন ১২৮৫৯ ভোট।
ক্ষমতার পথে? নেপালি কংগ্রেসের অনুগামীরা। কাঠমান্ডু, ২০ নভেম্বর। ছবি: রয়টার্স
এই কেন্দ্রে নেপালি কংগ্রেস দলের বিজয়ী প্রার্থী ২০৩৯২ ভোট পেয়েছেন। আর এক প্রার্থী নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট)-এর প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন ১৩৬১৯ ভোট। অর্থাৎ প্রচণ্ড এখানে তৃতীয় স্থানে। পাঁচ বছর আগে এই কেন্দ্রেই নেপালি কংগ্রেসের একই প্রার্থীকে তিনি এগারো হাজারের বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন। একই ভাবে, দলের প্রথম সারির তাত্ত্বিক নেতা বাবুরাম ভট্টরাই একটি কেন্দ্রে পরাস্ত হলেও অন্য একটিতে জিতে কোনও ক্রমে নিজের মুখ রেখেছেন। প্রচণ্ডের স্ত্রী ও কন্যাও ভোটের ময়দানে ধরাশায়ী।
নেপালের পার্লামেন্ট তথা সাংবিধানিক গণপরিষদে মোট সদস্যসংখ্যা ৬০১। এঁদের মধ্যে ২৪০ জন সরাসরি নির্বাচিত, ৩৩৫ জন নির্বাচিত সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নীতিতে, বাকি ২৬ জন সরকার মনোনীত। এই লেখার সময় প্রথমোক্ত ২৪০টি আসনের মধ্যে ২৩৯টির ফল জানা গেছে। তাতে সর্বাধিক আসন নেপালি কংগ্রেসের, ১০৪টি; দ্বিতীয় স্থানে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ই মা লে), ৯২; প্রচণ্ডের দল মাত্র ২৫টি আসন পেয়ে কয়েক যোজন পিছনে, তিন নম্বরে। মাওবাদী-ঘনিষ্ঠ মধেসি দলগুলির অবস্থাও করুণ। অথচ ২০০৮ সালে যখন প্রথম বার গণপরিষদে ভোট হয়েছিল, তখন মাওবাদীরা এই ২৪০টি আসনের ঠিক অর্ধেক, অর্থাৎ ১২০টি আসনে জয়ী হয়েছিলেন। নেপালি কংগ্রেস ও সি পি এন (ই মা লে)-এর ঝুলিতে এসেছিল ৩৭ ও ৩৩টি আসন। সে বারের নির্বাচনের সামগ্রিক ফলের ভিত্তিতে কোনও দলই শেষ অবধি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। মাওবাদীরা বৃহত্তম দল হওয়ায় প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০৬, এই বছর দশেকে মাওবাদী আন্দোলন, সেই সূত্রে মাওবাদীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষের জেরে নেপালে অন্তত পনেরো-ষোলো হাজার মানুষ প্রাণ হারান। সশস্ত্র আন্দোলনের পথ (নেপালে যা ‘প্রচণ্ড পথ’ নামে পরিচিত) ছেড়ে শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়ার মাধ্যমে মাওবাদীরা যখন নির্বাচনে যোগ দেন, তখন নেপালে অনেকেরই মনে শান্তি ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের আশা জেগেছিল। ৯-১১’র পরে যে ভাবে জঙ্গি সংগঠনগুলি আমেরিকা ও পশ্চিমের অন্যান্য রাষ্ট্রের নিশানা হয়ে ওঠে, তার প্রেক্ষাপটে জঙ্গি আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া মাওবাদীদের পক্ষে কতটা সম্ভবপর, সে প্রশ্নও ছিল।
যা-ই হোক, সে বার জনমত যাচাইয়ের পরে প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় বিশেষ করে নেপালের গ্রামাঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত মানুষ যথেষ্ট আশায় বুক বেঁধেছিলেন। রাজধানীর কেন্দ্রগুলিতে তাঁর ও অন্যান্য মাওবাদী নেতাদের জয় শহরাঞ্চলেও মাওবাদীদের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রমাণ করেছিল। বন্দুকের ভয়েই হোক আর মাওবাদীদের প্রতি ভক্তিতেই হোক, জঙ্গি আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে নেপালের মোট ৭৫টি জেলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বস্তুত মাওবাদী-প্রভাবান্বিত ছিল। সেই প্রভাবকে গণতান্ত্রিক সমর্থনে পরিণত করার একটা সত্যিকারের চেষ্টা করবেন মাওবাদীরা, মানুষ সেই আশা করেছিলেন।
আশা পূর্ণ হয়নি। বিগত পাঁচ বছরে নেপালে অন্তত পাঁচ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রচণ্ডর ন’মাসের সংক্ষিপ্ত প্রধানমন্ত্রিত্বের পরে এক পর্যায়ে তাঁর দলেরই বাবুরাম ভট্টরাই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন নেপালে সংসদীয় গণতন্ত্রের ময়দানে থাকা দলগুলির চেয়ে নিজেদের আলাদা প্রমাণ করতে পারেননি মাওবাদীরা। এক সময়ের মাওবাদী ‘সেনা’দের পুনর্বাসনের নীতি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। একাধিক বার নির্ধারিত সময়সীমা বাড়িয়েও নেপালের নতুন সংবিধান রচনা করাও সম্ভব হয়নি। দলের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকায় মোহন বৈদ্য ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে মাওবাদী সংগঠনে ফাটল ধরেছে। রাজতন্ত্র বা হিন্দু রাষ্ট্রের অবসান হলেও দেশের যথেষ্ট আর্থিক বিকাশ ঘটেনি।
যে দেশে ১২৫টির মতো জনজাতি, নানা ধরনের ভাষা, সেই নেপালে এ বারে ভোটে অংশ নেওয়ার জন্য অন্তত ১২০টি রাজনৈতিক দল নিজেদের নাম নথিভুক্ত করিয়েছিল। উল্লেখ্য, প্রায় তিন কোটি মানুষের এই দেশটির আশি শতাংশের মতো মানুষ এখনও কৃষিজীবী। দেশে কাজের অভাব, অন্যত্র রোজগারের হাতছানিতে প্রতি বছর যুব সম্প্রদায়ের লাখচারেক মানুষ পশ্চিম এশিয়ায় বা মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেন। প্রবাসে কারখানায়, চাষের খেতে, নার্স বা নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবেই প্রধানত কাজ করেন তাঁরা। বিগত পাঁচ বছরে এ ছবি বদলায়নি। বরং নানা ধর্মঘট ও আন্দোলনের জেরে নিসর্গসমৃদ্ধ দেশটিতে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অর্থনীতির হাল আরও করুণ হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে মাওবাদীদের কিছু গোষ্ঠী সহ বেশ কিছু ছোটখাটো দল এ বারে নির্বাচন বয়কটের ডাক দিলেও তাতে সাড়া মেলেনি বললেই চলে। ভোটে অংশগ্রহণের হার ৭০ শতাংশ। দেশের কোনও কোনও এলাকায় ভোটের দিন পরিবহণ ধর্মঘট ডেকেও ভোটদাতাদের নিরস্ত করা যায়নি।
ভোটের ফলের যা গতিপ্রকৃতি, তাতে শেষ পর্যন্ত এ বারেও কোনও দলের পক্ষে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন। তবে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের আসনগুলির গণনা শেষ হলেও যে প্রচণ্ডর দল তৃতীয় স্থানেই থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই। নেপালি কংগ্রেস না কমিউনিস্ট পার্টি (ই মা লে), কারা বৃহত্তম দল হবে, তা জানতে আরও ক’দিন বাকি। কিন্তু ইতিমধ্যেই নিজেদের ভরাডুবি অনিবার্য বুঝে প্রচণ্ড ভোটগণনা স্থগিত করার দাবি তুলেছিলেন। নেপালের নির্বাচন কমিশন বা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল, কেউই এই দাবির সারবত্তা খুঁজে না পেলেও কিছু সমস্যা থাকছেই।
প্রথমত, যে দলই বৃহত্তম হোক, জোট সরকার অবশ্যম্ভাবী। তাই প্রধান দলগুলির পারস্পরিক বোঝাপড়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, আগামী এক বছরের মধ্যে দেশের নতুন সংবিধানের রূপরেখা ঠিক করতে গেলে মাওবাদীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা আবশ্যক। এ বারের ভোটে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের অনেক জায়গাতেও মাওবাদীদের পরাজয় ঘটেছে বটে, কিন্তু নতুন সংবিধান তৈরি করতে গেলে তাঁদের সহযোগিতা দরকার হবে। তাই সব দলের তরফেই নমনীয়তা একান্ত কাম্য। নতুন সংবিধান রচিত হলে তবেই আগামী দিনে নেপালের দীর্ঘমেয়াদি বিকাশের রূপরেখা রচনা সম্ভব। এই মুহূর্তে অনেক নেতা বা দলই পারস্পরিক সহযোগিতার কথা, নমনীয়তার কথা বলছেন। কিন্তু সাংবিধানিক গণপরিষদ এবং সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার গড়ে উঠলে যদি সেই কথা ফের ক্ষমতার ভাষার আড়ালে চাপা পড়ে যায়, তা হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন নেপালবাসী। মাওবাদীরা ফের অস্ত্র তুলে না নিলেও, পড়শি নেপাল গণতন্ত্রের পথে ফের পা হড়কালে ভারতের উদ্বেগ কিন্তু বাড়বে। এ বারের ভোট নেপালে গণতন্ত্রের নতুন ভোর আনবে, না নেপাল এখনও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার শিকারই থেকে যাবে, সে দিকে তাই সকলেরই নজর থাকবে।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.