পশ্চিমবঙ্গের পঁয়ত্রিশ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের শূন্যপদের জন্য যে সতেরো লক্ষ প্রার্থী ‘টেট’ নামে পরিচিত পরীক্ষায় বসিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে মাত্র এক শতাংশ পাশ করিয়াছেন, যাহার ফলে শূন্যপদের মাত্র অর্ধেকই পূরণ করা সম্ভব হইবে। পরিসংখ্যানটি চমকপ্রদ। কেননা কেবল উচ্চমাধ্যমিক পাশ করিলেই প্রাথমিক শিক্ষক পদের প্রার্থী হওয়া যায়, কিন্তু স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমনকী পিএইচ ডি ডিগ্রিধারীরাও এই পরীক্ষায় বসিয়াছিলেন। রাজ্যে শিক্ষিত বেকারের সমস্যা কতটা ভয়াবহ, ইহা তাহার একটি নমুনা মাত্র। তবে আরও ভয়াবহ সংবাদ, তাঁহাদের যোগদানের পরেও ফলাফলের এই হাল।
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য পরীক্ষার এই ফলকে ‘অত্যন্ত আশাপ্রদ’ বলিয়া শংসাপত্র দিয়াছেন! তাঁহার মতে, শূন্যপদের পঞ্চাশ শতাংশ পূরণ করা গিয়াছে, সুতরাং সাফল্যের হার এক নহে পঞ্চাশ শতাংশ। সংখ্যাতত্ত্বের কুশলী ব্যবহার লইয়া নানা রসিকতা প্রচলিত আছে। শিক্ষামন্ত্রীর উক্তিটি সেই তালিকায় ঐতিহাসিক সংযোজন বলিয়া গণ্য হইবে। তিনি অবশ্য রসিকতা করিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কর্তারা অবশ্য এই ফলকে ব্যর্থতা বলিয়াই গণ্য করেন, তাহার কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজনও অনুভব করেন। প্রসঙ্গত, বামফ্রন্ট আমলের এক শিক্ষামন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষক পদের জন্য পরীক্ষার এই ফলাফলে ‘বিস্ময়’ ব্যক্ত করিয়াছেন। আত্মসমীক্ষার মানসিকতা কিঞ্চিৎ অবশিষ্ট থাকিলে অথবা সম্পূর্ণ স্মৃতিভ্রষ্ট না হইলে তিনি দেখিতে পাইতেন, রাজ্যে শিক্ষার মানের এই অধোগমন গত দুই-আড়াই বৎসরের ব্যাপার হইতে পারে না। তিন দশকেরও অধিক কাল ধরিয়া শিক্ষার গণতান্ত্রিকীকরণের নামে বামপন্থীরা সর্ব স্তরে শিক্ষার উৎকর্ষকে যে ভাবে জলাঞ্জলি দিয়াছেন, প্রাথমিক শিক্ষকের যোগ্যতাসম্পন্ন পর্যাপ্ত প্রার্থী না-পাওয়া তাহারই পরিণাম। আজকের এই শিক্ষক-পদ-প্রার্থীরা ছাত্রাবস্থায় যে-সব শিক্ষকের কাছে অধ্যয়ন করিয়াছেন, সেই সব শিক্ষক তাঁহাদের ছাত্রাবস্থায় যাঁহাদের কাছে পাঠ লইয়াছিলেন, সেই সব প্রজন্মও তো বামফ্রন্টের আমলেই লালিত। এখন ওই প্রার্থীদের অযোগ্যতায় এত বিস্মিত হওয়ার কী আছে?
দুর্ভাগ্য এই রাজ্যের পড়ুয়াদের, বিশেষত সেই সব প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়াদের, বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ার সামর্থ্য বা সুযোগ কোনওটিই যাহাদের নাই। এই সব অকৃতকার্য কিংবা কোনও ক্রমে পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়া শিক্ষকদের হাতেই তো তাহাদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ ন্যস্ত থাকিতেছে। শিক্ষামন্ত্রী তো স্পষ্টই নির্দেশ দিয়াছেন, যে সতেরো লক্ষ প্রার্থী এ বার পাশ করিতে পারেন নাই, তাঁহাদের অচিরে আবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ মিলিবে এবং সে জন্য পরীক্ষা বাবদে কোনও ফি-ও জমা দিতে হইবে না। আশঙ্কা হয়, বাকি শূন্যপদ পূরণের জন্য আর যত জনকে প্রয়োজন, দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় তত জনকেই পাশ করাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা হইবে না তো? খিড়কির দরজা দিয়া ‘সফল’ হওয়া শিক্ষকরা স্কুলে-স্কুলে পড়াইতে নিযুক্ত হইবেন না তো? তখন, ‘একশো শতাংশ সাফল্যে’ শিক্ষামন্ত্রীর পরিতৃপ্তি সম্পূর্ণ হইবে। যে শিশুরা সেই সফল শিক্ষকদের নিকট পাঠ লইবে, বড় হইয়া তাহাদের অনেকেও নিশ্চয় শিক্ষক পদের প্রার্থী হইয়া একই রকম ‘সাফল্য’ অর্জন করিবে। শিক্ষার উত্তরাধিকার এই ভাবেই ধারাবাহিত হইবে। ইহাকেই বুঝি পরিবর্তন বলে। |