রাত তখন আড়াইটে।
‘লেবার রুম’-এর ঠিক পাশের ঘরেই ঘুমিয়ে রয়েছেন কয়েক জন অন্তঃসত্ত্বা। নবজাতককে কোলের পাশে নিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন কয়েক জন প্রসূতিও। হঠাৎই পোড়া গন্ধে ঘুমটা আলগা হয়ে এসেছিল এক অন্তঃসত্ত্বার। চোখ খুলে দেখেন, কয়েক হাতের মধ্যেই দাউদাউ করে জ্বলছে ঘরের দরজা। সম্বিৎ ফিরতেই বাকিদের ঘুম ভাঙিয়ে পড়ি কি মরি করে হাসপাতালের বাইরে ছুট!
ভাগ্যিস ঘুম ভেঙেছিল ওই মহিলার! না হলে শনিবার গভীর রাতে কত বড় বিপদ যে হতে পারত, তা ভেবেই শিউরে উঠছে পুরুলিয়ার মানবাজার গ্রামীণ হাসপাতালের লেবার রুমের পাশের ঘরে থাকা সাত রোগিণী। আগুন লাগার খবরে আতঙ্ক ছড়ায় অন্তর্বিভাগে বাকি রোগীদের মধ্যেও। হাসপাতাল কর্মী ও রোগীর আত্মীয়দের চেষ্টায় আধ ঘণ্টার মধ্যে আগুন নিভলেও রাতে কেউ আর ওই ঘরে ঢোকার সাহস পাননি। হাসপাতালের বারান্দাতেই কাটিয়েছেন বাকি রাত। বিপদ এড়াতে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় হাসপাতালের বিদ্যুৎ সংযোগও। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দুর্ভোগ আরও বাকি ছিল। ঘটনার পরপরই প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয় দুই অন্তঃসত্ত্বার। লেবার রুমে রীতিমতো টর্চের আলো জ্বেলে কোনও রকমে ওই দু’জনের প্রসবের ব্যবস্থা করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। |
এখানেই আগুন লেগেছিল।—নিজস্ব চিত্র। |
রবিবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল ভর্তি থাকা সাত রোগিণীই ওই ঘরে ফিরেছেন। ঘরের দরজায় পোড়া চিহ্ন। দরজার মুখে বিদ্যুতের তার পুড়ে ছাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমান, শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগে ফিউজ বক্সে। সকালে অবশ্য নতুন তার এনে জোড়তালি দিয়ে আলো জ্বালানো হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ৩০ বছর আগে শেষ বার এখানে বিদ্যুতের ‘ওয়ারিং’-এর কাজ হয়েছে। যে ঘরে আগুন লাগে, তার পাশেই শৌচাগারের দেওয়াল স্যাঁতস্যাঁতে, নোনা ধরা। হাসপাতালের চিকিৎসক সুকুমার সরেন বলেন, “লেবার রুমের পাশেই ওই ঘরে থাকা অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতিদের চিৎকার শুনে স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীর আত্মীয়েরা তাঁদের ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে যান।” হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ ও রোগীদের অভিযোগ, আগেও অপারেশন থিয়েটারের সামনে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লেগেছিল। এ বিষয়ে জানানো সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেননি।
অগ্নিকাণ্ডের পরেই প্রসব বেদনা উঠেছিল স্থানীয় বোরো থানার বুরুডি গ্রামের প্রসূতি বসুমতী হাঁসদার। ফুটফুটে ছেলের মুখটা প্রথম দেখতে পেয়েছিলেন টর্চের আলোতেই। এ দিন আতঙ্ক কাটিয়ে ফের ওই ঘরে ফিরে বলছিলেন, “ঘুমের মধ্যেই পোড়া গন্ধটা নাকে আসছিল। ঘুম ছুটতেই আগুন নজরে এল। ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলাম।” তাঁর চিৎকারেই সবার ঘুম ভাঙে। সূতি বৃন্দাবনপুরের শেফালি মাহাতো, মানবাজারের সুপ্রিয়া সেনের কথায়, “অন্ধকারের মধ্যে কারা যেন টেনে হিঁচড়ে আমাদের বাইরে নিয়ে এল। না হলে কী হত, ভাবতেই পারছি না।” ভেলাগড়ার বাসিন্দা জয়দেব মুর্মুর স্ত্রীও সদ্যোজাত শিশুপুত্রকে নিয়ে ওই ঘরে ছিলেন। “প্রথমে মাথাটা কাজ করছিল না। পাশেই থাকা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র কাজে লাগানোর কথাও মাথায় আসেনি। যেখানে যা পেয়েছি, সেই পাত্রে জল এনে আগুন নেভাতে শুরু করি। কোনও বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি, এটাই রক্ষা,” বললেন জয়দেববাবু।
প্রশিক্ষণের জন্য বাইরে আছেন ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক অরুণাভ ঘোষ। ফোনে বলেন, “আমি সবে দায়িত্বে এসেছি। ফিরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।” মানবাজারের তৃণমূল বিধায়ক তথা ওই হাসপাতালের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন সন্ধ্যারানি টুডু। তিনি বলেন, “শনিবার রাতে একটা ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত। সমিতির পরের বৈঠকে হাসপাতালের বিদ্যুতের হাল দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।” পুরুলিয়ার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষের দাবি, “প্রতি বছর বর্ষার পরেই সব হাসপাতালের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হয়। এ বারও তাই হচ্ছিল। কিন্তু, ওই ঘরের পাশে ড্যাম্প থাকায় মনে হচ্ছে শর্ট সার্কিট হয়েছে। আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করছি।”
এলাকার মানুষ অবশ্য বলছেন, আগুন লাগল বলেই বিদ্যুতের এই দশার কথা জানা গেল। না হলে তো এ ভাবেই চলত! |