সাংসদ-সাংবাদিক কুণাল ঘোষের জামিনের আর্জি খারিজ করে রবিবার তাঁকে পাঁচ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিলেন বিধাননগরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট। আর এ দিন থেকেই লোকসভা ভোটের আগে শাসক দলকে কোণঠাসা করতে চেয়ে সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে ফের সুর চড়াতে শুরু করল বিরোধী দলগুলি। রবিবারই সিবিআই তদন্ত চেয়ে পথে নেমেছে বামেরা। বিধানসভায় সরব হওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। কুণালের থেকে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে সেই আক্রমণ মোকাবিলার কৌশল নিচ্ছে তৃণমূল।
পুলিশ সূত্রে খবর, শনিবার সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ কুণালকে গ্রেফতার করার পরে রাত প্রায় তিনটে পর্যন্ত তাঁকে দফায় দফায় জেরা করেন বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দারা। ভোর পৌনে পাঁচটার সময় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে কুণালের কম্পিউটারের সিপিইউ বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। তার পর বিধাননগর দক্ষিণ থানায় ফিরিয়ে এনে সকাল দশটায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে।
শনিবার কুণালকে গ্রেফতার করার পরে রাত দশটা নাগাদ তাঁর নামের ফেসবুক পেজে তাঁর জবানিতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং কয়েক জন নেতা-মন্ত্রী-সাংসদের নামে একটি দীর্ঘ পোস্ট প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়, এই নেতাদের প্রশ্ন করলে সারদা-মামলার অনেক তথ্য সামনে আসবে। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কুণালের নামে কী ভাবে এই পোস্ট এল, তা নিয়ে শনিবারই জল্পনা শুরু হয়েছিল। পুলিশ সূত্রে দাবি, কুণালের পরিচিত কেউ ওই পোস্টটি করেছেন। রাতেই কুণালের বন্ধু এক সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং এক সাংবাদিককে থানায় ডেকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দারা।
রবিবার সকালে ধোঁয়াশা আরও বাড়িয়ে পোস্টটি উধাও হয়ে যায়। ফলে একটা মহলে প্রশ্ন ওঠে, তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের নাম থাকাতেই কি পুলিশ পোস্টটি মুছে দিল। পুলিশ সূত্রে অবশ্য সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে বলা হয়েছে, সম্ভবত ভিন্ রাজ্য থেকে কেউ মন্তব্যটি মুছে দিয়েছেন। |
বিধাননগর আদালতে কুণাল ঘোষ। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক। |
তৃণমূল নেতারা অবশ্য জানাচ্ছেন, ওই ফেসবুক পোস্ট নিয়ে তাঁরা আদৌ বিচলিত নন। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “যে যার নিজের বক্তব্য জানাতেই পারে। এ ব্যাপারে আমরা মাথাই ঘামাচ্ছি না।” তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য, “আইন তার নিজের পথে চলবে।”
দলের অন্য একটি অংশ অবশ্য বিষয়টাকে এতটা হাল্কা ভাবে নিচ্ছেন না। কুণালের ফেসবুক মন্তব্যে তাঁর নাম থাকায় কুড়ি কোটি টাকার মানহানির মামলা করার হুঁশিয়ারি দিয়ে আইনজীবীর নোটিস পাঠিয়েছেন সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। কাঁথি থানায় কুণালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগও দায়ের হয়েছে। আর সারদা-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রীর নাম জড়ানোর চেষ্টা হলে বাংলায় আগুন জ্বলবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মন্ত্রী মদন মিত্র। পাশাপাশি নিজের নাম জড়ানো প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “এমন অভিযোগ আসবে জানলে শহিদ মিনার থেকে ঝাঁপ দিতাম। তাতে আমার বীরের মৃত্যু হতো।” এই গোটা পর্বে এক তৃণমূল নেতার সরস মন্তব্য, “দলের মধ্যে পরস্পর-বিরোধী শিবির এই এক জনের (কুণাল) ধাক্কায় একজোট হয়ে গিয়েছে!”
বিতর্কিত ওই ফেসবুক মন্তব্যকে অস্ত্র করে বিরোধীরা যে ভাবে সরব হয়েছে, তার মোকাবিলায় শাসক দলের এই একজোট হওয়াটা জরুরি ছিল বলেই মনে করছেন অনেকে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “যে হেতু মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং সাংসদদের নাম এসে গিয়েছে, তাই আমাদের দাবি আরও জোরদার হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের তদারকিতে সিবিআই তদন্ত হোক।” ঝোলা থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ার পরে এখন সিবিআই তদন্ত ছাড়া গতি নেই বলে মন্তব্য করেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুও। কুণালের নাম না-করলেও এক বিবৃতিতে বামফ্রন্ট বলেছে, রাজ্য সরকার গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করে প্রতারকদের রক্ষা করার কাজে নেমেছে। এ দিনই বারাসতে এ নিয়ে মিছিল করেছে ফরওয়ার্ড ব্লক, বর্ধমানে সিপিএম।
কুণালের মন্তব্য নিয়ে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বকে বিঁধেছেন তৃণমূলে বিক্ষুব্ধ সাংসদ সোমেন মিত্রও। তাঁর বক্তব্য, “বিশেষ এক জনকে গ্রেফতার করলেই হবে না। সততার প্রতীকের গায়ে কালি লেগেছ যখন, তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিবিআই তদন্ত করানো উচিত। তাতে স্বচ্ছতা প্রমাণিত হবে।” আর, রাজ্যসভার সাংসদ কুণালের নিজের দাবি, তাঁকে অন্যায় ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে শনিবার রাত থেকে অনশন করছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ কুণালকে বিধাননগর কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগের দিনই, শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলনে কান্নাকাটি করেছিলেন কুণাল। এ দিন সকালে কিন্তু তাঁকে বেশ হাসিমুখেই দেখা গিয়েছে। ছাইরঙা ট্রাউজার, সবুজ হাফহাতা শার্ট পরে হাতে একটি লাল রঙের ব্যাগ নিয়ে থানা থেকে বেরোন তিনি। ফেসবুক পোস্ট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে হাত নেড়ে বলেন, “যা বলার আদালতেই বলব।” সাংবাদিকদের ভিড় এড়াতে পুলিশ কুণালকে ঢুকিয়ে তড়িঘড়ি গাড়ি ছেড়ে দেয়।
কোর্ট লকআপে এ দিন কুণালের সঙ্গে এক খুনের আসামি-সহ চার বিচারাধীন বন্দিও ছিলেন। সাড়ে ১২টা নাগাদ ওঁদের সকলকে এজলাসের লকআপে আনা হয়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বেঞ্চের শেষ প্রান্তে গিয়ে বসেন কুণাল। চোখ বুজে মাথাটা এলিয়ে দেন দেওয়ালে।
পৌনে একটা নাগাদ কুণালের আইনজীবী সুদীপ্ত মৈত্র, সৌরভ চট্টোপাধ্যায়, সৌম্যজিৎ রাহা, দেবযানী রায়চৌধুরী ও দেবপ্রতিম গুহ সওয়াল শুরু করেন। গম্ভীর মুখে শুনতে থাকেন কুণাল। আইনজীবী সুদীপ্ত মৈত্র আদালতে জানান, রাজ্য পুলিশ ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা মিলিয়ে মোট ১৩ বার কুণালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এত দিন পরে কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হল, বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, সারদা কেলেঙ্কারির যে ৩৪ নম্বর মামলায় কুণালকে ধরা হয়েছে, সেটিতে মূলত সুদীপ্ত সেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। প্রাথমিক অভিযোগপত্রেও কুণালের নাম নেই বলে আইনজীবীর বক্তব্য। তিনি বলেন, ওই মামলায় আর যাঁদের নাম ছিল, তাঁরা জামিন পেয়েছেন। কুণালকেও জামিন দেওয়া হোক।
কোর্টে সুদীপ্তবাবু বলেন, পুলিশের আবেদনে দাবি করা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের টিডিএস (ট্যাক্স ডিডাকটেড অ্যাট সোর্স) জমা না পড়ার বিষয়ে কুণালের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বিষয়টিতে একমাত্র যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তিনি সুদীপ্ত সেন। কুণালবাবুর আইনজীবীর দাবি, পুলিশ বিভিন্ন সময়ে জোর করে বিভিন্ন তথ্য কুণালের কাছ থেকে আদায় করার চেষ্টা করেছে।
এর পরেই বিশেষ সরকারি আইনজীবী শেখর চক্রবর্তী আদালতকে জানান, কুণালবাবু সারদা মিডিয়া গোষ্ঠীর সিইও ছিলেন। তাই টিডিএস জমা না পড়ার বিষয়ে অবশ্যই তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। পুলিশ আগেই তাঁকে গ্রেফতার করতে পারত। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে তাঁর কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানার ছিল। তাই সময় নেওয়া হয়েছে। সারদার এত টাকা কোথায় গেল সে বিষয়ে কুণালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও, তিনি সে রকম সহযোগিতা করেননি বলে শেখরবাবু আদালতে জানান। শেখরবাবুর দাবি, কুণালবাবু মাসিক ১৫ লক্ষ টাকা বেতন পেতেন। কিন্তু তাঁর নাম ‘পে রোল’-এ নেই কেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। এই সব কারণেই তাঁকে পুলিশি হেফাজতে রেখে তদন্ত চালাতে চায় পুলিশ।
এই সময় লকআপ থেকে কুণাল বলে ওঠেন, “স্যার, আমি কিছু বলতে চাই। আমার কিছু বলার আছে।”
বিচারক কুণালকে আইনজীবীর মাধ্যমে কথা বলতে বলেন। তখন আইনজীবী সৌম্যজিৎ রাহার সঙ্গে মিনিট তিনেক কথা বলেন কুণাল। সৌম্যজিৎ আদালতে জানান, কুণাল মূলত তিনটি কথা বলতে চেয়েছেন— এক, ১৫ লক্ষ টাকা বেতনের বিষয়ে সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও আয়কর সংক্রান্ত ফাইল জমা দেওয়া হয়েছে। দুই, তিনি সারদার কোনও আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত নন। তিন, জেরায় তিনি পুলিশকে যা জানিয়েছেন, তা যেন ঠিক মতো খতিয়ে দেখা হয়।
এর মধ্যেই ফের চেঁচিয়ে উঠে কুণাল বলেন, “আইও-কে (তদন্তকারী অফিসার) বলুন, যে নামগুলো বলেছি, সেগুলো মুখে বলতে।” কিন্তু ওই কথার প্রেক্ষিতে কেউ কোনও মন্তব্য করেননি। সওয়াল-জবাবের শেষে বিচারক পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজতের কথা ঘোষণা করেন।
পৌনে ২টো নাগাদ কুণাল বাইরে বেরনোমাত্র সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরতে থাকেন। কুণালও কিছু বলার জন্য এগোচ্ছিলেন। “আমার অনশন চলছে। ষড়যন্ত্র হয়েছে। সব বলব,” বলে কথা শুরুও করেছিলেন। তখনই পুলিশ কুণালকে টেনে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। |