গোয়েন্দাপ্রধানের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ
১১ দফা জেরার দিনে গ্রেফতার সাংসদ কুণাল
তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষকে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার করল পুলিশ। শনিবার সন্ধ্যায় বিধাননগর পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁর বিরুদ্ধে ৪২০ (প্রতারণা), ৪০৬ (অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ) এবং ১২০-বি (ষড়যন্ত্র) ধারায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। রাত প্রায় পৌনে ৮টা নাগাদ বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষ জানান, নির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে কুণালবাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কুণালবাবুর গ্রেফতারের খবর দিতে গিয়ে বিধাননগর কমিশনারেটের দফতরে সাংবাদিকদের অর্ণববাবু বলেন, “সারদা-কাণ্ডে সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে কুণাল ঘোষও সমান ভাবে ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। তদন্তে তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বলেই তাঁকে গ্রেফতার করা হল। তিনি এখন আমাদের হেফাজতেই রয়েছেন।” গোয়েন্দা প্রধান জানান, বিধাননগর সেক্টর ফাইভ থানায় এ বছর এপ্রিল মাসে সারদা গোষ্ঠীরই একটি সংস্থা ব্রডকাস্ট ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের এক জেনারেল ম্যানেজার অভিযোগ দায়ের করেন। যার কেস নম্বর ৩৪। ওই অভিযোগের তদন্তের ভিত্তিতেই কুণালবাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতার হওয়ার পরে সাংসদ কুণাল ঘোষ। শনিবার বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী
পুলিশ জানিয়েছে, কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে কর্মীদের বেতন না দেওয়া এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা জমা না দেওয়ার অভিযোগ (কেস নম্বর ৩৪) এনেছিলেন ব্রডকাস্ট ওয়ার্ল্ডওয়াইড লিমিটেডের কর্তা ইন্দ্রজিৎ রায়। পুলিশের দাবি, এই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মিলেছে। বিধাননগরের গোয়েন্দাপ্রধান অবশ্য বলেছেন, “কুণালবাবু সারদা গোষ্ঠীর চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার ছিলেন। আপাতত শুধু মাত্র ৩৪ নম্বর কেসটিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। তাই ওঁকে গ্রেফতার করা হল। তদন্তের ভিত্তিতে পরে সারদা-কাণ্ডের অন্য মামলাগুলিতেও তাঁকে অভিযুক্ত করা হতে পারে।” শুক্রবারই কুণাল ঘোষ নিজের বাড়িতে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সাংবাদিকদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি দাবি করেছিলেন, সারদার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের টাকা কোথায় কোথায় আছে, তা শনিবারের মধ্যে না-জানালে তাঁকে গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ। তিনি কোনও অপরাধ করেননি বলে দাবি করে কুণাল জানান, তিনি কখনওই আগাম জামিনের আর্জি জানাবেন না। কাল এ কথা বললেও শনিবার দুপুরে কিন্তু পুলিশকে পাল্টা চাপে ফেলার চেষ্টা করেন তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ। বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় গিয়ে কুণাল বিধাননগর পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধানের বিরুদ্ধে তাঁকে গ্রেফতারের হুমকি, হয়রানি করা ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেন। এই অভিযোগ প্রসঙ্গে গোয়েন্দাপ্রধান কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি শুধু বলেন, “অভিযোগ যখন আমার বিরুদ্ধে, আমি এই নিয়ে কিছু বলব না। যা বলার পুলিশ কমিশনার বলবেন। আইন আইনের পথে চলবে।” এই অভিযোগ দায়ের হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই কুণালকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
কুণাল নিজেকে নির্দোষ বলে যে দাবি করেছেন সে সম্পর্কে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায় শুধু বলেছেন, “আইন আইনের পথে চলবে।”
কুণালবাবুকে গ্রেফতার করা হলেও ঠিক এক দিন আগে তিনি সারদা-কাণ্ডে আরও অনেকে জড়িত বলে যে অভিযোগ করেছিলেন, সে ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ? অর্ণববাবু জানিয়েছেন, শুক্রবার কুণাল সারদা-কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আরও কয়েক জনের নাম জানিয়েছেন।
পুলিশ সেই সব লোকেদের জেরা করবে কি? গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, “তদন্তের স্বার্থে এখনই ওই বিষয়ে কিছু বলা যাবে না।” সারদা-কাণ্ডে যে সব বড় বড় মাথা জড়িত বলে এত দিন তিনি অভিযোগ করেছেন, গ্রেফতার হলে তাঁদের সকলের নাম তিনি পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করে দেবেন বলে গত কালই জানিয়েছিলেন কুণাল। তিনি এ-ও বলেছিলেন, সারদা-গোষ্ঠীর কাছ থেকে যাঁরা দিনের পর দিন সুবিধা ভোগ করেছেন, তাঁরা আজ ‘বাংলার ঘরে ঘরে ভগবান জ্ঞানে পূজিত!’ তবে তাঁরা কারা, সে ব্যাপারে বিস্তারিত ভাবে এখনও কিছু বলেননি কুণাল।
সারদা-কাণ্ডের পর থেকে কুণালকে এর আগে দশ বার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায় পুলিশ। প্রতি বারই তিনি পুলিশের সামনে হাজির হন। এ দিনও জেরা করার জন্য পুলিশ তাঁকে ডেকে পাঠায়। কিন্তু বেলা দু’টো নাগাদ দেখা যায়, কুণালবাবু বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় ঢুকছেন। সেখানে গোয়েন্দাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। এর পাঁচ ঘণ্টা পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মাঝের এই কয়েক ঘণ্টা তিনি ওই থানাতেই ছিলেন। পুলিশ কর্তাদের দাবি, এক জন সাংসদকে গ্রেফতার করতে হলে যে বিধি মানা উচিত, কুণালবাবুর ক্ষেত্রে তা সবই করা হয়েছে। কুণালবাবুকে গ্রেফতারের আগে বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের কর্তারা নিজেদের মধ্যে ঘণ্টাখানেক বৈঠক করেন। গ্রেফতারের পরে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় এক চিকিৎসককে আনা হয়। তাঁকে দিয়ে কুণাল ঘোষের শারীরিক পরীক্ষা করায় পুলিশ।
কুণালের বক্তব্যকে হাতিয়ার করে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের দাবিতে ফের সরব হয়েছে বামেরা। একই সঙ্গে এই প্রশ্নে তৃণমূলকেও নিশানা করছে তারা। আলিমুদ্দিনে এ দিন বামফ্রন্টের বৈঠকের পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “তৃণমূলের সাংসদ কুণাল ঘোষ যে সমস্ত অভিযোগ করেছেন, তার পরে সিবিআই তদন্ত ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই। আমরা আগেই সিবিআই তদন্তের দাবি করেছি।
এখন ওঁদের দলের লোকজন যা বলছেন, তার পরে সিবিআই তদন্ত আরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।” প্রয়োজনে আদালতের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তের কথাও এ দিন আবার বলেছেন বিমানবাবু।
কুণালের অভিযোগের সূত্র ধরেই বিমানবাবু এ দিন বলেন, “ওঁকে বলির পাঁঠা করার চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে হয়। সারদার ঘটনায় ওঁর নিশ্চয় ভূমিকা ছিল। কিন্তু যাঁদের হয়ে উনি এই কাজ করেছেন, তাঁরাও যেন ছাড় না পায়।”
এ দিনই চুঁচুড়ায় পুর-কর্তাদের সঙ্গে একটি বৈঠকে কুণালের শুক্রবারের বক্তব্য প্রসঙ্গে মুখ খোলেন রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, “আমরা রাজনীতি করি। আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের নীতি-আদর্শ থাকে। ওঁর তা নেই, তা ওঁর কথা থেকেই পরিষ্কার।” কুণাল ঘোষের সঙ্গে শাসক দলের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ফিরহাদ বলেন, “ওঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু উনি এখনও শাসক দলের সাংসদ হিসেবেই রয়েছেন। আগে ইস্তফা দিন। তার পরে যা বলার বলুন।” ফেসবুকে কুণাল ঘোষের নামে যে ‘অফিসিয়াল পেজ’ রয়েছে, তাঁর গ্রেফতার হওয়ার কিছু ক্ষণ পরে সেখানে তাঁর নামেই একটি মন্তব্য ‘পোস্ট’ করা হয়। সেই পোস্টে কুণাল নিজেকে আরও একবার নির্দোষ বলে দাবি করে লিখেছেন, ‘আমার কাজ, আমার পেশাকে ব্যবহার করে পিছন থেকে ছুরি মারা হল’। একই সঙ্গে ওই পোস্টে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও মন্ত্রী-সহ বারো জনের নাম তুলে তাঁর প্রশ্ন, ‘যাঁরা সেনকে (সুদীপ্ত সেন) চিনতেন, সারদার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য পেয়েছেন, কিংবা অন্য ভাবে
জানেন, তাঁদের তদন্তে সাহায্য চাওয়া হোক’। ওই পোস্টে তিনি সারদা-কাণ্ডে আরও একবার সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ার পরে কুণালবাবুর নামে ওই পেজ-এ কে মন্তব্য পোস্ট করল? পুলিশের বক্তব্য, গ্রেফতার হওয়ার পরে কুণালবাবুর নিজের হাতে কোনও ভাবেই এ কাজ করা সম্ভব নয়। তাঁরই নির্দেশে কেউ পোস্টটি করেছে বলে বলে অনুমান পুলিশের।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.