ডিকার স্বপ্নের গোলে অভিষেক ডার্বিতেই বাজিমাত আর্মান্দোর
ক বছর আগের শিলিগুড়ির সুভাষ ভৌমিক আর রবিবার যুবভারতীর করিম বেঞ্চারিফাকে মিলিয়ে দিয়ে গেলেন লালরিন্দিকা রালতে। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের আদরের ডিকা।
বিমানে থাকায় ডার্বি দেখা হয়নি চার্চিল কোচের। কিন্তু এখনও ফেড কাপের ছিটকে যাওয়ার গোলটা মনে আছে তাঁর। “আমরাই ছিলাম টুর্নামেন্টের সেরা দল। কিন্তু ডিকার ওই অপ্রত্যাশিত গোলটা হারিয়ে দিয়েছিল। প্রচণ্ড আফসোস হয়েছিল ছিটকে যাওয়ার জন্য। শুনলাম তো আজও ও রকম গোলই করেছে। বাঁ দিকের ওই একই জায়গা থেকে,” গোয়া থেকে বলছিলেন সুভাষ।
আর ম্যাচের আধ ঘণ্টা পর করিম বেঞ্চারিফার মুখটা দেখে মনে হল, পারলে কেঁদেই ফেলেন। “ইস্টবেঙ্গলের কাছে নয়, ব্যক্তিগত দক্ষতার কাছে হারলাম। বলতে পারেন ডিকার কাছেই হারলাম। ইস্টবেঙ্গল শেষ ছ’টা ম্যাচে যে গোলগুলো পেয়েছে, সবই বক্সের বাইরে থেকে করা। ক্লাসে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছিলাম। ডিকার সঙ্গে লোবো, চিডির কথাও বলেছিলাম। ডিকা সুযোগটা পেয়ে গোলটা করে দিয়ে গেল। ব্রিলিয়ান্ট গোল,” বলছিলেন হতাশ বাগান কোচ।
মিজো ভাষায় লালরিন্দিকা শব্দের অর্থ ‘দ্য কিং থিঙ্কস রাইট’। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা তাঁর নাম দিতেই পারেন আমাদের ‘ফিনিক্স পাখি’। ডিকার বাঁ পায়ের একটা কাট আউট তাঁবুর সামনেও রেখে দিতে পারেন তাঁরা। গত বারের চার্চিল বধের ফেড কাপ সেমিফাইনাল, এ এফ সি কাপ, আই লিগের প্রথম ডার্বি চার-চারটে এ রকম গোল এসেছে ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের এই মানসপুত্রের বাঁ পা থেকে। ব্রিটিশ কোচের আবিষ্কার মিজোরামের লুমলেই গ্রামের নিরীহ চেহারার এই ছেলেটা-ই রবিবার হয়ে গেলেন ‘ওস্তাদো কা ওস্তাদ’! ইস্টবেঙ্গলকে আই লিগের প্রথম ডার্বি জিতিয়ে।

সেই গোল। নায়ক লালরিন্দিকা। রবিবার
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে শঙ্কর নাগ দাসের তোলা ছবি।
সুভাষ ভৌমিকের মতো অনেকেরই ডিকাকে দেখে তাঁদের সময়ের সুকল্যাণ ঘোষদস্তিদার, প্রণব গঙ্গোপাধ্যায়, সুরজিৎ সেনগুপ্তদের কথা মনে পড়ছে। বক্সের বাইরে থেকে ওঁরাও এ রকম গোল করেছেন বহু বার। বিপক্ষের আঠারো গজ বক্সের বাঁ দিকের বাইরে আরও পাঁচ-সাত গজ জায়গা যে এখন ভারতীয় ফুটবলে তাঁরই অঞ্চল, সেটা এ দিন আরও এক বার প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন বছর একুশের ডিকা। টিম-তালিকায় যাঁর নাম থাকে অনূর্ধ্ব ২৩ জুনিয়র ফুটবলার হিসেবে। নব্বই হাজারের যুবভারতীতে যখন শুধুই কিপার বনাম কিপার লড়াই দেখতে দেখতে দর্শকরা ক্লান্ত, তখন যেন মুক্ত বাতাস এনে দিল তাঁর বাঁক খাওয়ানো একটা শট। গোল বক্সের গজ পাঁচেক বাইরে থেকে বাঁ পায়ের সোয়ার্ভিং শটটা যখন গোঁত্তা খেয়ে ডেড-লিফ শট হয়ে বাগান গোলে আছড়ে পড়ল, মনে হল দু’টো শিল্টন পাল গোলে দাঁড়ালেও এটা হয়তো রোখা যেত না!
“বিশ্বমানের গোল। ওর ডান পা-টা যদি আর একটু সচল হয়, ছেলেটা জিনিয়াস হবে,” বলছিলেন উচ্ছ্বসিত গোয়ান কোচ আর্মান্দো কোলাসো। এ দিনের ডার্বি নতুন ইস্টবেঙ্গল কোচের কাছে ছিল স্বপ্নপূরণের রাত। তাঁর বাড়ির আলমারিতে ট্রফির অভাব নেই। দেশের সব ট্রফি থরে থরে সাজানো। তা সত্ত্বেও তাঁর পুরনো ক্লাব আর্মান্দোকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে পাঠানোয় গুমরে মরছিলেন তিনি। ফলে এ দিনের ম্যাচ দীর্ঘ কোচিং জীবনের একটা বিশেষ মোড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল দেশের অন্যতম সেরা কোচকে। সে জন্যই সম্ভবত ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল দু’হাত আকাশে তুলে হাঁটু মুড়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ডেম্পোকে পাঁচ বার আই লিগ দেওয়া কোচ। বাকরুদ্ধ। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল আনন্দাশ্রু। ডেম্পো ছিল তাঁর হাতে গড়া শিশু। ষোলো-সতেরো বছর ধরে লালন করেছিলেন। ইস্টবেঙ্গলে তিন দিন মাত্র এসেছেন। টিমের ঘাঁতঘোঁত কিছু জানেন না। লাল-হলুদের আগুনে গ্যালারির সামনে রিজার্ভ বেঞ্চে শুরুতে তাঁকে যেন কেমন জড়োসড়ো লাগছিল। ম্যাচের পর বলেও ফেললেন, “এএফসি কাপে এক বার মনে হয় গোয়ায় এত লোকের সামনে আল সাদাতের সঙ্গে খেলেছিলাম। তার পর আবার।”
গোয়ায় বসে শুনেছেন কলকাতা ডার্বির কথা। কিন্তু সেটা যে এত উত্তেজক, রঙিন, প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বল হয়, সেটা মনে হয় জানতেন না। না হলে ম্যাচের পর অর্ধেক গ্যলারিতে যখন রাতের অন্ধকারে জ্বলছিল কাগজের মশাল, তখন সে দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন কেন? গোয়ার বিভিন্ন উৎসবে আরব সাগরে ভাসানো প্রদীপ ভেসে ভেসে দূরে চলে যাওয়ার দৃশ্য হয়তো মনে পড়ছিল আর্মান্দোর।
ডার্বি জেতার রং না জানলেও অভিজ্ঞ আর্মান্দো জানতেন, তিনি যদি স্ট্র্যাটেজি তৈরির ‘ওল’ হন, তা হলে বিপক্ষের কোচ করিম ‘বাঘা তেঁতুল’। আর্মান্দো বনাম করিমের প্রথম কলকাতা ডার্বির লড়াই তাই বেশির ভাগ সময়ই আটকে গেল অঙ্কের জাঁতাকলে। দাবার চাল দেওয়ার মতো বিপক্ষের রাজা, বোড়ে, নৌকোকে অকেজো করে দেওয়ার লড়াই চালালেন দু’জনই। নিট ফল, জ্বলে উঠতে পারলেন না ওডাফা, কাতসুমি, চিডি, সুয়োকা, মোগার মতো তারকারা। বলতে দ্বিধা নেই, এ দিন বিদেশিরা সবাই ফেল। সব থেকে খারাপ অবস্থা ওডাফার। দু’কোটি দিয়ে ওঁকে যে কেন পুষছে বাগান, কে জানে! পুরো ফিট নন। আর এরিক মুরান্ডা তো আরও খারাপ। বিদেশিদের ব্যর্থতার দিনে ভেসে উঠলেন স্বদেশিরা। চিডি-মোগাকে রুখে দিয়ে যেমন, শুরুতে কাঁপতে থাকা বাগানের স্বদেশি ডিফেন্স লেটার মার্কস পেয়ে গেল এ দিন। তেমনই দুই কিপার বাগানের শিল্টন পাল আর বেঙ্গলের অভিজিৎ মণ্ডল দেখালেন, গোলের নীচে এখনও অতনু, ভাস্কর, তনুময়, হেমন্তদের পরম্পরা প্রবহমান। এই জায়গাটা অন্তত এখনও বঙ্গসন্তানদের হাতে সুরক্ষিত। কোনও বিদেশি এখনও থাবা বসাতে পারেনি সেখানে।
বাগানের এরিকের যে গোলটা শুরুতেই দিনাজপুরের অভিজিৎ বাঁচালেন, সেটা অবিশ্বাস্য। পরে ওডাফার হেড আর ওয়ান টু ওয়ানে নিশ্চিত দুটো গোলও অসাধারণ সেভ করেছেন। আর্মান্দো আর অভিজিতের মধ্যে অদ্ভুত একটা টেলিপ্যাথি কাজ করে সব সময়। ডেম্পোর চারটে আই লিগের সময় আর্মান্দোর টিমকে রক্ষা করতেন অভিজিৎ। পুরনো কোচের কলকাতায় নতুন ক্লাবে অভিষেকের ম্যাচ স্মরণীয় করে রাখল শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতই। একই ভাবে এরিক-ওডাফাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতার দিনে মছলন্দপুরের শিল্টন পাল ছিলেন অনবদ্য। সুয়োকার যে বলটা তিনি রুখলেন, তা একশোয় একশো পাবে। তাঁর আউটিংও ছিল চোখে পড়ার মতো। দুই কোচের নিখুঁত স্ট্র্যাটেজির জন্যই সম্ভবত ম্যাচটা আটকে থাকল মাঝমাঠে। ওডাফার জন্য জোনাল মার্কিং, চিডি-সুয়েকার জন্য কিংশুক, আইবর, ডেনসনদের তাড়া করে যাওয়া রঙিন ম্যাচকে পানসে করে দিয়েছে মাঝেমধ্যে। ডাউন দ্য মিডলে শুধুই পায়ের জঙ্গলে আটকে গিয়েছে আক্রমণ। উইং প্লে-র পাল্টা উইং প্লে বা দু’দলের সেট পিসের ব্যর্থতা চোখে পড়েছে বারবার।
কিন্তু ম্যাচের সব অন্ধকার, ব্যর্থতা শুষে নিল দ্বিতীয়ার্ধের মাধামাঝি হওয়া ডিকার গোল। যা শিলিগুড়ি, কুয়েত ঘুরে রং লাগাল এ দিনের যুবভারতীতেও। সল্টলেকের দখল ফের তুলে দিল লাল-হলুদের হাতে। চিডি, মোগা, সুয়োকা নয়, ম্যাচ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা পরও উদ্বেল সমর্থকরা নাগাড়ে গেয়ে চলেছেন, ‘লা-ল-রি-ন্দি-কা/করিম চাচা ভোকাট্টা’।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.