আপনি করিম বেঞ্চারিফার জায়গায় থাকলে কী করতেন?
সল্টলেকের বাড়িতে বসে দেশের অন্যতম সফল কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে দিলেন, “সাহস দিতাম। নতুন ছেলেদের বলতাম, তোমরাই সেরা। তোমাদের কেউ হারাতে পারবে না। যা ভুল হবে সব আমার দোষ। যা ঠিক হবে সব তোমাদের কৃতিত্ব। এভাবেই বাহাত্তরে মালয়েশিয়ার সেলেঙ্গারের বিরুদ্ধে আই এফ এ শিল্ডের সেমিফাইনাল ম্যাচ জিতেছিলাম। আকবরকে বসিয়ে আনকোরা শম্ভু মৈত্রকে নামিয়ে দিয়েছিলাম। দু’গোল করে জিতিয়েছিল বাচ্চা ছেলেটা। তারুণ্যের জেদ কাজে লাগাতে পারলে সেটা কিন্তু ভয়ঙ্কর হয়। কোনও অঙ্ক মানে না।”
আর্মান্দো কোলাসোর মতো কোনও ক্লাবের হয়ে প্রথম ম্যাচটাই যদি ডার্বি হত, আপনি কোচ হলে কতটা চাপে পড়তেন?
জ্যাংড়ার বাড়িতে ফোনে ধরা হলে ‘ডায়মন্ড’ কোচ অমল দত্ত হো হো করে হেসে ওঠেন। “উড়তাম। শুধুই উড়তাম। হারলে চাকরি যাওয়ার তো চিন্তা নেই। তা হলে চাপ কীসের? হারলে সবাই বলত সবে এসেছে, তিন দিনে কী করবে? জিতলে বলবে, দেখেছ লোকটা এ জন্যই পাঁচ বার ডেম্পোকে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছে।”
১৯২৫-এ ডার্বির জন্মের পর কলকাতা ঘটি-বাঙালের লড়াইয়ের অনেক রং দেখেছে। কিন্তু পিকে বনাম অমল দত্তের মতো বিরামহীন তরজা কখনও দেখেনি। |
পি-কের ভোকাল টনিক এখনও ‘মিথ’ হয়ে ঘোরে। অমল দত্তের ভাইচুংকে ‘চুংচুং’ বা স্যামি ওমোলোকে ‘ওমলেট’ বলে দেওয়াও ম্যাচ হারার জন্য সেরা ‘খলনায়ক কোট’ হয়ে বিবেচিত হয় এখনও।
আর্মান্দো কোলাসো বনাম করিম বেঞ্চারিফার আজ রবিবারের লড়াইয়ে অবশ্য ফিরে এসেছে অন্য মোড়কের ‘ভোকাল টনিক’। গত কয়েক দিন ধরে নাগাড়ে তাঁর দলের নতুন আনকোরা ছেলেদের ডার্বি-ভীতি কাটাতে ক্লাস নিয়েছেন বাগান কোচ। নানা ভাবে ‘টনিক’ দিয়েছেন। পাশাপাশি ডার্বিতে ফিরে এসেছে বিপক্ষকে তাতিয়ে দেওয়ার মতো ‘কোট’-ও। শুক্রবার বিকেলে ঐতিহাসিক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে ঠাট্টার ছলে ওডাফাকে লক্ষ করে বলা ইস্টবেঙ্গল কোচের কথাগুলো নাকি তাতিয়ে দিয়েছে মোহনবাগান গোলমেশিনকেও। অন্তত বাগান ড্রেসিংরুম থেকে সে রকম খবরই চুঁইয়ে বেরোচ্ছে।
ভোকাল টনিক বা তাতানোর ‘ওষুধ’ আদৌ কাজে লাগল কি না, সেটা রবিবার রাতের আগে বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু এ বারের আই লিগের প্রথম ডার্বির ধুন্ধুমার যুদ্ধ যে দু’টো বৃত্তে ঘোরাফেরা করছে সেটা এখনই বলা যায়।
এক) অভিজ্ঞতা না তারুণ্য, জিতবে কে?
দুই) ডার্বিতে অভিষেক হলে কোনও কোচ সফল হন কি না?
প্রীতম কোটাল, শৌভিক ঘোষ, রোউইলসন, এরিক মুরান্ডা, কাতসুমি— মোহনবাগানের প্রথম একাদশের পাঁচ ফুটবলারের ডার্বি খেলার অভিজ্ঞতাই নেই। রিজার্ভে থাকা রাম মালিক, শঙ্কর ওরাও, আদিল খানও কখনও যুবভারতীর লক্ষ দর্শকের ভয়ঙ্কর শব্দব্রহ্মের সামনে পড়েননি। ইস্টবেঙ্গলের সেই সংখ্যাটা এক- জেমস মোগা। জোয়াকিম আব্রাঞ্চেজ এ দিন চোট পেয়েছেন। তিনি থাকলে সংখ্যাটা দুই হত। রাত পর্যন্ত যা খবর তাতে তিন বিদেশি নিয়েই হয়তো শুরু করবে ইস্টবেঙ্গল। মোগাকে বাইরে রেখে। চিডি-সুয়োকা জুটি নিয়ে। অভিজ্ঞ আর্মান্দো তালগাছের মতো লম্বা সুদানি স্ট্রাইকারকে ব্যবহার করার কথা ভাবছেন পরের দিকে। বাগানের স্বদেশী ব্রিগেডের ‘পাঁচ ফুটিয়া’ ডিফেন্ডারদের মাথার উপর দিয়ে গোল করার জন্য। ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে যুবভারতীতে ডেম্পো-স্টাইলে যে সেট পিসগুলো করাচ্ছিলেন কোলাসো, তা দেখে মনে হল গোলের জন্য মোগা-আঁকশিতে অনেকখানিই ভরসা রাখছেন তিনি। শুরুটা তিনি করতে চাইছেন সুয়েকা, ডিকা, খাবরা, লোবোদের নিয়ে দৌড় এবং দৌড়ের স্ট্র্যাটেজিতে। বাগানের তারুণ্যের হইহই করে এগোনো আটকাতে এটাই পাল্টা চাল কোলাসোর। আর ওডাফা আটকাতে থাকছে জোড়া জোনাল মার্কিং। ওডাফাকে প্রথম ধরবেন মেহতাব, সেকেন্ড বল ধরবেন ডিফেন্ডাররা। |
কোলাসোকে সাত বছর ধরে দেখছেন করিম। গোয়ান কোচকে অভিষেক ম্যাচেই তেতো মুখে ড্রেসিংরুমে ফেরত পাঠানোর জন্য মরক্কান কোচের সেরা অস্ত্রটিম গেম। অনুশীলনে দেখা গেল সেটার উপরই জোর দিচ্ছেন তিনি। ফুটবলারদের গোল করে দাঁড় করিয়ে সেই চেষ্টাই চলল নানা চমকপ্রদ অনুশীলনে। কাতসুমি, ওডাফা, শৌভিকদের ‘স্নেক ডান্স’ দেখে পুরো টিমের সে কী হাততালি! হাসাহাসি! কোলাসো এ দিন বলে দিয়েছেন, “তিন পয়েন্টই লক্ষ্য। এক পয়েন্ট পেলেও অখুশি হব না। কলকাতায় আই লিগ আনাই লক্ষ্য।” চতুর করিম তাঁর লক্ষ্য নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। বলে দিয়েছেন, “জেতার জন্য ভাল খেলতে হবে। ভাল খেললেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব।” জেতার জন্য করিমের টেক্কা ওডাফা। এ দিন অনুশীলনের সময় দেখা গেল ওডাফা দু’হাত তুলে হাততালি দিতে বলছেন সমর্থকদের। নিজেও তালি দিচ্ছেন। চার্জড, লক্ষ্যে অবিচল, তুরীয় মেজাজের এই গোলমেশিনকেই চাইছেন করিম। পাল্টা আক্রমণে যাওয়ার জন্য।
বেশ কয়েক বছর পর লাল-হলুদ স্বদেশি কোচের হাতে। বাগান আস্থা রেখেছে বিদেশি কোচেই। ডার্বি ঠিক করে দিতে পারে, কোন কর্তারা ঠিক? বেঙ্গল না, বাগান। করিমের ভারতীয় ডিফেন্স যদি চিডি-মোগা-সুয়োকাদের আটকে দিতে পারে তবে সেটাও বড় ঘটনা হবে নিঃসন্দেহে। তবে স্ট্র্যাটেজির যা আঁচ পাওয়া যাচ্ছে তাতে স্বদেশি আর বিদেশি কোচের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। ৪-১-৩-২ ফর্মেশনেই পছন্দ করছেন দু’জনই।
বাগান তাঁবুতে ঐতিহাসিক যৌথ সম্মেলনের পর গ্যালারিকে শান্ত রাখতে যৌথ একটি শান্তির ব্যানার নিয়ে আজ খেলতে নামবেন দু’দলের ফুটবলাররা। থাকছে প্রচুর পুলিশ। জলের বোতল-সহ বাজি ফাটানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকছেই। কিন্তু সে-সবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফেসবুকে উপচে পড়ছে খেউড়। নোংরা ছবি। ফলে শেষ পর্যন্ত শান্তির বাতাবরণ কতটা থাকবে তা নিয়ে চিন্তায় দু’দলের কর্তারাই।
আর্মান্দো বনাম করিমের আই লিগ যুদ্ধে দু’ধাপ এগিয়ে রয়েছেন গোয়ান কোচ-ই। চোদ্দো সাক্ষাতে কোলাসো জিতেছেন আট বার। করিম পাঁচ। করিম কি ব্যবধান কমাতে পারবেন? না কি কোলাসো আরও এগিয়ে যাবেন? পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “ইস্টবেঙ্গলকে আমি অভিজ্ঞতার জন্য ৫৫-৪৫ এগিয়ে রাখব।” আর অমল দত্তের মন্তব্য, “ডার্বির ভবিষ্যদ্বাণী করব, পাগল না কি? ডার্বিতে কত ফেভারিট টিম মাথা নিচু করে চলে গেল।”
পিকে-অমল কবেই বা এক রাস্তায় হাঁটলেন! |