অষ্টআশি বছরের কলকাতা ফুটবলের ডার্বি-সংস্কৃতি কি বদলে যাচ্ছে? বাঙাল-ঘটির আবেগ বিস্ফোরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর শক্তিস্থলেও মরচে ধরতে শুরু করল নাকি? সেই বিতর্ক উসকে দিল শুক্রবার বিকেলের মোহনবাগান তাঁবু।
মোহনবাগানের ঐতিহাসিক সবুজ লনে যা ঘটল সেটাও ঐতিহাসিক-ই। নজিরবিহীন ভাবে বড় ম্যাচের আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে একই মঞ্চে হাজির ধুন্ধুমার যুদ্ধের নায়কেরা। বাগানের ডাকে ইস্টবেঙ্গলের কোচ, অধিনায়ক, কর্তা হাজিরএকই মঞ্চে পাশাপাশি বসে আর্মান্দো কোলাসো-করিম বেঞ্চারিফা, ওডাফা ওকোলি-মেহতাব হোসেন। একে অন্যকে ফুল দিচ্ছেন। লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন পতাকা বিনিময় করছেন দুই অধিনায়ক। হাসিমুখে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবির পোজ দিচ্ছেন।
১৯৮০-র ১৬ অগস্ট মর্মান্তিক দুর্ঘটনা পারেনি। ৯ ডিসেম্বর ২০১৩-র ইটের আঘাতে রহিম নবির কপালের রক্ত আর মোহনবাগানের নির্বাসন ও জরিমানা কিন্তু সেটা করে দিল। ঘটি-বাঙাল, চিংড়ি-ইলিশের যুদ্ধ বহাল রেখেও সৌজন্যের একটা মঞ্চ তৈরি করে দিল রবিবারের আই লিগের প্রথম ডার্বির আগে। সদস্য-সমর্থকদের উদ্দেশে দুই প্রধানই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করল লড়াই নব্বই মিনিটের। এবং সেটা মাঠে। গ্যালারিতে নয়।
পাশাপাশি বসে আর্মান্দো এবং করিম দুই কোচই প্রকাশ্যে বললেন, “খেলা হবে মাঠে। ফল যাই হোক সবাই সেটা মেনে নিন।” কিন্তু সেটা তো মঞ্চে বসে বলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল উত্তেজনার চোরাস্রোত।
কয়েক হাত দূরে বসে থাকা বিপক্ষের সেরা অস্ত্র ওডাফার দিকে তাকিয়ে ইস্টবেঙ্গল কোচ হাসতে হাসতে বললেন, “ওডাফা চোট সারিয়ে ফিরে এসেছে। তবে চাইব ও যেন পুরো নব্বই মিনিট মাঠে না থাকে।” মজা করেই হয়তো বলা। কিন্তু ময়দানের প্রথম গোয়ান কোচের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কথাটা চৌম্বকে যেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মনের কথারই অনুরণন তুলে দিয়ে গেল। |
অষ্টআশি বছরের পুরনো ডার্বির নতুন ছবি। ছবি: উৎপল সরকার। |
আড় চোখে আর্মান্দোর দিকে তাকিয়ে বাগান কোচের কিছুক্ষণ পরে মন্তব্য, “ইস্টবেঙ্গল যখন এএফসি সেমিফাইনাল খেলছিল তখন এই ম্যাচটা হলে বলতাম, পারব না। কিন্তু এখন বলছি আমার তরুণ বিগ্রেড তৈরি। যে কোনও চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে ওরা।” দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকশো বাগান সমর্থকের মধ্যে হাততালির ঝড় উঠল। এই সমর্থকরাই কিছুক্ষণ আগে লাল-হলুদের আর্মান্দো-মেহতাবরা বাগান-তাঁবুতে ঢোকার সময় ‘ওয়েলকাম ইস্টবেঙ্গল’ ধ্বনি দিয়েছিলেন।
আর্মান্দো আর করিমের মধ্যে সম্পর্ক সেই গোয়া থেকেই সাপে-নেউলে। তৎকালীন ডেম্পো কোচ হাতের আঙুল জড়ো করে একটা বিশেষ পোজ দিয়ে দেখাতেন, “যারা সারাক্ষণ ব্লা ব্লা করে আমি সে রকম কোচ নই।” অনর্গল কথা বলতে ভালবাসা করিম-ই লক্ষ ছিলেন তখন বুঝতে অসুবিধা হত না। পাল্টা করিমও সে সময় আর্মান্দোকে লক্ষ করে বলতেন, “ডেম্পোর মতো সাজানো-গোছানো দল পেলে যে কোনও কোচের পক্ষে আই লিগ জেতা সম্ভব।” গোয়া ছেড়ে দু’জনেই এখন কলকাতা ডার্বির আবহে ঢুকে পড়েছেন। নেমে পড়েছেন রিং-এ। গোয়ার রাশভারী, গম্ভীর কোলাসো নিজেকে বদলে ফেলেছেন কলকাতায় এসে। হাসিখুশি। সবার সঙ্গে কথা বলছেন। যে-কোনও প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। মিডিয়ার চাপ সামলাচ্ছেন। অন্য দিকে করিম তো শহরটার ভাষাই শিখে ফেলেছেন। মরক্কান কোচ সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলায় বলছেন, “ভাল প্রশ্ন করেছেন’, ‘কেমন আছেন’। কিন্তু পুরোপুরি কি মনোভাব বদল হয়েছে দু’জনের সম্পর্কে? মনে হল না! করিমের হাত থেকে ফুলের তোড়া নেওয়ার ঘোষণা হতেই আর্মান্দোর কপালে ভাঁজ। ভাবটা এটা আবার কেন? একবারও একে অন্যের প্রশংসা করেননি। নামও মুখে আনেননি।
আই লিগে কলকাতা ডার্বির গুরুত্ব কতটা তা নিয়েও দেখা গেল দু’জন ভিন্ন মেরুতে। “ডার্বি আমার কাছে আর একটা ম্যাচ। ডার্বি জিতলেও তিন পয়েন্টই পাব। হারলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না,” আর্মান্দো বলার কিছুক্ষণ পর করিম বলে দিলেন, “বহু দিন কলকাতায় আছি। ডার্বির গুরুত্ব সদস্য-সমর্থকদের কাছে কী জানি। গত দু’সপ্তাহে সচিন তেন্ডুলকরের পর ডার্বি নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা আর লেখালেখি হচ্ছে এখানকার মিডিয়ায়। এই ম্যাচটা জেতার আনন্দই আলাদা। জানি এটা থেকে তিন পয়েন্টই আসতে পারে। তবুও এটা স্পেশ্যাল।”
পাশাপাশি দুই কোচ, দুই অধিনায়ক— চোখা চোখা প্রশ্ন তাঁদের মাঝেমধ্যে যে অস্বস্তিতে ফেলেনি তা নয়। সঞ্চালক তথা এই যৌথসভার প্রধান উদ্যোক্তা মোহনবাগান অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন, “শুধুই ডার্বি নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। ম্যাচ কমিশনার রয়েছেন। এএফসি-র নিয়ম মানতে হবে।” তাই অন্য প্রশ্ন হয়নি। কিন্তু ওডাফার দিকে প্রশ্ন উড়ে এসেছে, আপনি লাল কার্ড দেখার পরই কিন্তু গত বছর ৯ ডিসেম্বরের ডার্বিতে ঝামেলা বেড়ে গিয়েছিল! সকালে অনুশীলনে দেখা গিয়েছে, গোল করার পর দু’হাত তুলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। মরসুমের প্রথম আই লিগ গোল করার জন্য মরিয়া ওডাফা প্রশ্নটা শুনে মাথা চুলকোলেন। “রেফারিং ভাল হওয়া দরকার। রেফারি একপেশে খেলালে তো ফুটবলাররা উত্তেজিত হবেই। ওই ম্যাচের পরেও তো ডার্বি ম্যাচ হয়েছে, আমরা হেরেছি। মেনে নিয়েছি।” অধিনায়কের কথা শুনে করিম তাঁর পিঠে হাত রাখেন। তখনই মেহতাবকে লক্ষ করে প্রশ্ন, মোহনবাগানের কেউ লালকার্ড দেখলে আবার হাততালি দেবেন না তো? ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক অস্বস্তিকর প্রশ্ন সামাল দেন এই বলে, “পুরনো কথা মনে রাখি না। সব ম্যাচ মন দিয়ে খেলি আর জিততে চাই।” মেহতাবদের নতুন কোচের কাছে প্রশ্ন ছিল, মাত্র তিন দিন অনুশীলন করিয়েছেন— ফর্মেশনে কি বদল আনছেন? “যে ভাবে ইস্টবেঙ্গল খেলছিল সেটাই রাখছি। শুধু যেগুলো ভুল ছিল সেগুলো ধরিয়ে দিচ্ছি। টিম এখন ঠিক রাস্তায় চলছে। বাকিটা রবিবার নব্বই মিনিটে বোঝা যাবে।” আর ফর্মেশনের প্রশ্নে করিমের মন্তব্য “আমার টিম তিন রকম ফর্মেশনে খেলে। খেলা চলতে চলতে সেটার বদল হয়।”
কিন্তু ডার্বিতে জিতবে কে? মোহনবাগান কি সত্যিই আন্ডারডগ? ইস্টবেঙ্গল কি অনেক এগিয়ে? প্রশ্ন শুনে আর্মান্দো সতর্ক। করিমও। “এই ম্যাচে কেউ এগিয়ে নেই। নব্বই মিনিট শেষ হওয়ার আগে বলা যাবে না, কে ভাল, কে খারাপ।” পাঁচ বারের আই লিগ জয়ী কোচ শান্ত গলায় বলার পর করিমের কাছ থেকে আসে সতর্ক জবাব। “এটা এশিয়ার সবচেয়ে বড় ডার্বি। ম্যাচে অনেক ফ্যাক্টর থাকে। টেকনিক্যাল, মেন্টাল... সেগুলোই ম্যাচ জেতায়।” ঘণ্টাখানেক ধরে চলা ঐতিহাসিক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে সৌজন্যের বাতাবরণেও বেরিয়ে আসে গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা। জেতার উদগ্র ইচ্ছার মুখ। থাকবেই তো! এটা যে ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান। বাঙালির চিরকালের আবেগের লড়াই! |